মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১১

Daily Amardesh -ঢাকা, সোমবার ৩০ মে ২০১১, ১৬ জৈষ্ঠ্য ১৪১৭, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৩২ হিজরী

Daily Amardesh -ঢাকা, সোমবার ৩০ মে ২০১১, ১৬ জৈষ্ঠ্য ১৪১৭, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৩২ হিজরী

সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশকে সংবিধানশূন্য করেছে

স্টাফ রিপোর্টার
দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণকে দমিয়ে রেখে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার হীন উদ্দেশ্যেই সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশকে সংবিধানশূন্য করেছে। বিরোধী দল ও মতের নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর ওপর গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে সরকার নিপীড়কের ভূমিকায় নামিয়েছে। দেশে সংবিধান নেই। সে কারণেই মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারও নেই। মানুষের জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই। আয়বৈষম্য বেড়ে চলেছে। বহু প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র আজ বিপন্নপ্রায়। শ্বাসরুদ্ধকর এ পরিস্থিতি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে উদ্ধার করতে প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ফ্যাসিবাদী ও চরম স্বৈরাচারী এ সরকারের পতনে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘লিবারটি বাংলাদেশ’ আয়োজিত সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে একথা বলেন।
‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ শীর্ষক এ সেমিনারে বক্তব্য রাখেন সাবেক রাষ্ট্রদূত রাশেদ আহমদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কামালউদ্দিন সবুজ, সাবেক সভাপতি খন্দকার মনিরুল আলম, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুস শহীদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি কাজী রওনাক হোসেন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ও বিশিষ্ট ছড়াকার আবু সালেহ, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বাকের হোসাইন প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে মাহমুদুর রহমান দেশে সাংবিধানিক শূন্যতার জন্য বর্তমান সরকারকে দায়ী করে বলেন, একটি সিনেমা হলের মালিকানাকে কেন্দ্র করে দায়ের করা রিটের শুনানি শেষে আদালত সংবিধানের গোটা পঞ্চম সংশোধনীই বাতিল করে দিয়েছেন। আপিল বিভাগের এ রায়ের পর সরকার অনেকটা তড়িঘড়ি করে সংবিধান ছাপায়। প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে ছাপানো এ সংবিধান সম্পর্কে বলা হলো, এটা হচ্ছে খসড়া সংবিধান। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বললেন, খসড়া সংবিধান বলতে কিছু নেই। পরে আইনমন্ত্রী বললেন, রায়ের আলোকে মুদ্রিত এ সংবিধান অনুযায়ীই দেশ চলছে। এ ঘটনার পর পঞ্চম সংশোধনী বিষয়ে আপিল বিভাগের দেয়া রায় রিভিউ করার জন্য আবার আবেদন করে সরকার। এ রিভিউরও রায় হয়েছে। এছাড়াও পরবর্তী সময়ে সপ্তম সংশোধনী ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছে। অথচ এ রায়গুলোর আলোকেও সংবিধান ছাপানোর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং বিশেষ কমিটি নামে একটি কমিটি করে সংবিধান সংশোধনের নামে জাতিকে গভীর সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেয়ার আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে ফেলেছে। দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে মাহমুদুর রহমান বলেন, আইন অনুযায়ী একটি চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করে থাকে। নাগরিকরা রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকে আর রাষ্ট্র তাদের জীবনের নিরাপত্তা, মৌলিক ও মানবাধিকার নিশ্চিত করে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র নাগরিকের সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার রাষ্ট্রের সব যন্ত্রকে বিকল করে ফেলেছে। চুক্তি ভঙ্গ করে রাষ্ট্র এখন একটি নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ অবস্থায় মানবাধিকার থাকতে পারে না। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা দেশকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দেশে অত্যাচারী শাসকশ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছে। এ অবস্থায় মানুষ বাঁচার তাগিদেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পক্ষপাতমূলক আচরণের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের মানুষ ইনসাফ পাচ্ছে না। বিচার বিভাগের হাতে মানুষ বেইনসাফের শিকার। ক্ষমতাসীনরা বিচার বিভাগকে দলীয় অঙ্গসংগঠনে পরিণত করেছে। বিচারের নামে দেশে মূলত তামাশা চলছে। একথা বলার কারণেই আমাকে সাজা দেয়া হয়েছে। অথচ এখন একথা শুধু দেশের মানুষই বলছে না, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার প্রতিবেদন, টিআইবি প্রতিবেদন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে আসছে। আদালত এখন তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সাহস দেখাতে পারছে না। কেননা আদালতের নৈতিক শক্তি নেই। আদালতের এ অবস্থা থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিত্রও ভিন্ন নয়। এটা নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজনও নেই। কেননা এই ট্রাইব্যুনাল যারা গঠন করেছেন, তাদের নির্দেশ মতোই সবকিছু হবে। এটা দেশের মানুষ মোটামুটি ধরেই নিয়েছে। ইতোমধ্যেই এ আদালত পক্ষপাতমূলক আদেশ দেয়া শুরু করেছে। গ্রেফতারকৃতদের একজনকে জামিন দিয়েছে। অন্যদের দেয়া হলো না কেন? এ প্রশ্ন সবখানে উঠছে। অথচ আদালত এ বিষয়টি আমলেই নিচ্ছেন না।
কামালউদ্দিন সবুজ বলেন, মানবাধিকারের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। একটি ছাড়া অপরটি অচল। এ দুটির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় চেতনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে এদেশে শাসকপক্ষের লোক আর শাসিতদের কাছে গণতন্ত্রের রূপ ভিন্নরকম। দেশে শাসরুদ্ধকর একটা অবস্থা বিরাজ করছে। স্বাধীনতার ৪০ বছরেও জনগণ মানবাধিকার ভোগ করতে পারেনি। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ৩০ ভাগও পত্রিকায় প্রকাশ পায় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাস্তব চিত্র আরও ভয়ঙ্কর। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে দেশে-বিদেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই এ বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করছেন। সবাই চায় যু্দ্ধাপরাধের বিচার হোক। তবে তা হতে হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির বিচার করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ব্যাপারে সরকারকে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এস এম রাশেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রের মা খ্যাত আমেরিকায় যেখানে বাইবেল নিয়ে শপথ নেয়া হয়, সেখানে এদেশে সেক্যুলারিজমের ভূত মাথায় চাপল কেন? এখানে তো একই সময়ে পাশাপাশি তারাবির নামাজ ও পূজা পালন করা হয়। তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে মার্কিন বিশেষজ্ঞ স্টিফেন র্যাপের পরামর্শগুলো যাচাই করে তা পূরণ করুন। তাহলে ট্রাইব্যুনাল থেকে সফলতা পাওয়া যাবে। অন্যথায় দেশ বিভক্ত হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতীতের পেছনে না ছুটে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি খন্দকার মনিরুল আলম বলেন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের শুরু থেকেই এটা আন্তর্জাতিক মানের কি-না তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ বিতর্ক ইচ্ছা করেই তৈরি করা হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, যে কোনো অপরাধের ন্যায়বিচার হতে হবে। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনালে ন্যায়বিচার হবে কি-না তা ভাবতে হবে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, যে দেশে চৌধুরী আলমের মতো ওয়ার্ড কমিশনার নিখোঁজ হয়, জনপ্রিয় পত্রিকা আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে মাসের পর মাস আটক, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, অসংখ্য মামলায় সারাদেশ ঘুরে বেড়াতে হয় সেখানে মানবাধিকার কী অবস্থায় আছে তা সহজেই বোঝা যায়। তিনি বলেন, শুধু চৌধুরী আলম বা মাহমুদুর রহমান নন, তাদের মতো শত শত মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে। নির্যাতন করাই যেন সরকারের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিকদের দমনের কাজে ব্যবহার করে এলিট ফোর্স র্যাবের ভাবমর্যাদা নষ্ট করা হচ্ছে। মানবাধিকার নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, তার প্রতিবাদ করতে হবে।
ডিইউজে সভাপতি আবদুস শহীদ বলেন, সমাজের মানবাধিকার পরিস্থিতির কথা বলতে এবং গণতন্ত্রের জন্য অবারিত তথ্যপ্রবাহ থাকা দরকার। কিন্তু বর্তমানে দেশে মিডিয়ায় ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। ভিন্নমতের সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করে পথে বসানো বা হয়রানিমূলক বদলি করা হচ্ছে। দিনদিন সাংবাদিক নির্যাতন যেভাবে বাড়ছে, তাতে আমরা শঙ্কিত। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ট্রাইব্যুনাল নিজেই পক্ষপাতদুষ্ট। তারা নিজেরাই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন