রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১১

যত্রতত্র কয়েকছত্র ০২ > একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে বাংলা একাডেমীর কবিতা পাঠের আসরে


যত্রতত্র কয়েকছত্র ০২ > একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে বাংলা একাডেমীর কবিতা পাঠের আসরে

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি
লিখেছেন লুৎফর রহমান রিটন msg (তারিখ: শনি, ০৬ Jun ২০০৯, ০১:০০ PM)
ক্যাটেগরি: 
ঘটনা ১৯৭৯ সালের।তার মানে আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। তখনও বাংলা একাডেমীর মূল মঞ্চে একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরে কবিতা পাঠের আসর বসতো।দেশের খ্যাতিমান কবিদের পাশাপাশি অনেক তরুণ এবং নবীন কবিও কবিতা পড়তেন সেই আসরে।তো সদ্যতরুণ আমারও ইচ্ছে হলো—যাই,একটা ছড়া পড়ে আসি।একুশে ফেব্রুয়ারি আসতে তখন আর মাত্র দুইদিন বাকি।খবর নিয়ে জানলাম আগে থেকেই নাকি নাম নিবন্ধন করতে হয়।অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাংলা একাডেমী ভবনে হাজির হলাম নিজের নামটা তালিকাবদ্ধ করতে।এই কাজটির দায়িত্বে তখন মুহম্মদ নূরুল হুদা।কবি তিনি।তাঁর কক্ষটি খুঁজে পাওয়া গেলেও তাঁকে পাওয়া গেলো না।খুঁজে খুঁজে খুঁজে খুঁজে অবশেষে তাঁর এক সহকর্মীর কক্ষে তাঁকে আবিস্কার করা গেলো।আমি আমার আগমনের হেতু বয়ান করার পর আমাকে হতাশ করে দিয়ে তিনি বললেন—নাম নিবন্ধনের সময় পার হয়ে গেছে। গতকাল পর্যন্ত ছিলো।আপনি দেরী করে ফেলেছেন।ওকে নেক্সট টাইম। আগামী বছর সময় মতো আসবেন।বলতে বলতে তিনি খোশগল্পে ফিরে গেলেন সহকর্মীর সঙ্গে।আমি তারপরেও খুব বিনীত ভংগিতে অনুরোধ করলাম—আসলে আমি ঠিক জানতাম না গতকাল লাস্ট ডেট ছিলো।হুদা ভাই কাইন্ডলি যদি আমার নামটা......।হুদা ভাই বিরক্ত হলেন—যান তো ভাই, ব্যস্ত আছি।
খুব মন খারাপ করে বাংলা একাডেমী থেকে বেরিয়ে এলাম।আহারে মাত্র পনেরো ষোলো ঘন্টার জন্য মিস করলাম।বাংলা একাডেমী থেকে বেরিয়ে শিশু একাডেমীর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।নিজেকে খুব বঞ্চিত মনে হচ্ছিলো।তো বঞ্চিতদের চেহারায় একটা বঞ্চিত বঞ্চিত ভাব থাকে।আমার অজান্তেই সদা হাস্যোজ্জল আমার চেহারাতেও ভর করে আছে সেই বঞ্চিত বঞ্চিত ভাবটা।এমন সময় সেই পথে উদয় হলেন আবু সালেহ।আমাদের ছড়াকারদের অলিখিত লিডার তখন তিনি।কথায় কথাই সালেহ ভাই জানতে চাইলেন—ঘটনা কি?তুমি কি বিমর্ষ?
আমি আমার সাম্প্রতিক বঞ্চনার ইতিহাস সালেহ ভাইকে বলবার সময় চেহারায় সেই বঞ্চিত বঞ্চিত ভাবটা যথাসম্ভব ধরে রাখতে সচেষ্ট হলাম।এবং সফলকামও হলাম।সালেহ ভাই বললেন—আরে এইটা কোনো ব্যাপার হলো?তালিকায় তোমার নাম নেই তো কি হয়েছে?আমার নাম তো আছে।আমাকে যখন পড়তে দেবে তখন আমি মাইকে তোমার নামটা নিজেই ঘোষণা করে দেবো।হুদার বাবার সাধ্য নাই আমাকে ঠেকায়।
--তাহলে সালেহ ভাই আমি একা কেনো আরো কয়েকজন ছড়াকারও ছড়া পড়ুক না এই সুযোগে!
--ভালো বলেছো তো। কিন্তু এইগুলারে পাবা কোথায় এই অল্প সময়ে?
--আমি এইগুলারে যোগাড় করে ফেলবো সালেহ ভাই।আপনে চিন্তা করবেন না।
আমি আর সালেহ ভাই যৌথভাবে দশজন তরুণ ছড়াকারের নাম প্রাথমিক ভাবে নির্বাচন করলাম। সিদ্ধান্ত হলো একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল আটটার ভেতরে এই দশজন ছড়াকারসহ আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে বাংলা একাডেমীর মূল ফটকের আশেপাশে।দুইদিন ধরে এইখানে ওইখানে হানা দিয়ে দিয়ে দশজন ছড়াপাঠাগ্রহীকে যোগাড় করা হলো।এবং একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা হারাধনের দশটি ছেলে সকাল আটটার ভেতরেই উপস্থিত হলাম বাংলা একাডেমীতে।কিন্তু সালেহ ভাইয়ের দেখা নেই। মঞ্চ আলো করে বসে থাকা বিখ্যাত কবিদের পাশে নেই,মূল ফটকের আশপাশে নেই, এমনকি মিছিল করে যে মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান—সেখানেও নেই।এখন হারাধনের নয়টি ছেলের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করবে কে? ওদিকে মঞ্চের কবিরা একে একে পাঠ করে যাচ্ছেন কবিতার পর কবিতা।অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।তাঁর পাশে কবি রফিক আজাদ,আসাদ চৌধুরী এবং আরো অনেক বিখ্যাত সব কবির সঙ্গে অল্পখ্যাত নবীন কবির বিরাট এক বাহিনী।ঘড়িতে সাড়ে আটটা।সালেহ ভাইয়ের দেখা নেই।ঘড়িতে পৌণে ন’টা। সালেহ ভাই নেই।ঘড়িতে ন’টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি—অবশেষে খুব আয়েসী ভংগিতে হেলতেদুলতে সালেহ ভাইয়ের ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটলো বাংলা একাডেমীতে।
--এতো দেরী করলেন সালেহ ভাই?
দেরীতে আসার জন্যে একটুও বিচলিত না হয়ে সালেহ ভাই বললেন—তুমি কোনো চিন্তা করো না তো।কবিরা সকাল সকাল উঠে বসে থাকে।ছড়াকাররা একটু দেরীতেই ওঠে।আমাদের সবার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর সালেহ ভাই বললেন—দ্যাও তোমাদের দশজনের নাম একটা কাগজে লিখে আমাকে দ্যাও।
দিলাম।
সালেহ ভাই বললেন—এইবার এই তালিকাটার আরেকটা কপি করো।
করলাম।
--এইবার এই দ্বিতীয় কপিটা তুমি হুদারে দ্যাও।দিয়ে বলো যে তোমরা এই দশজন ছড়া পড়তে চাও আজকে।
আমিও সালেহ ভাইয়ের নির্দেশ শিরোধার্য মেনে মঞ্চ লাগোয়া গ্রীণ রুমে গিয়ে হাজির।উঁচু মঞ্চের সিঁড়ির পাশে একাডেমীর কয়েকজন কর্মচারী-কর্মকর্তা কঠিন স্বেচ্ছাসেবকের সুকঠিন ভূমিকা পালনে ব্যস্ত।তাদের চোখ এড়িয়ে মানুষ তো মানুষ একটা মাছিও মঞ্চে উঠে যেতে পারবে না।কবি ঠেকানোর এরকম ভয়াবহ ব্যাবস্থাপনার ভেতরেও আমি নিচে দাঁড়িয়েই এক পর্যায়ে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হলাম।মহা বিরক্তির সঙ্গে তিনি এগিয়ে এলেন মঞ্চের কোণায়—দেখুন আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম এইবার হবেনা।তাও আপনি এসেছেন?প্লিজ আমাকে কাজ করতে দিন।
আমি লিডার আবু সালেহর শিখিয়ে দেয়া বুলি ডেলিভারি দিলাম—আমরা এই দশজন আজকে ছড়া পড়তে চাই।এই যে এখানে দশজনের নাম লেখা আছে।
আমার সরবরাহকৃত তালিকাটা হাতে নিতে নিতে মহা বিস্ময়ের সংগে উচ্চারণ করলেন তিনি—নিজেরই হয়না আবার দশজন!যান তো ভাই, যান যান......বলতে বলতে তিনি মঞ্চে নিজের আসনে গিয়ে বসলেন।
পূর্বনির্দেশ মোতাবেক আমি ফিরে এলাম দর্শক সারিতে।দর্শক সারির প্রথম কাতারেই বসে ছিলেন সালেহ ভাই।আমাকে অদূরে দেখতে পেয়ে ইশারায় ডাকলেন।গেলাম।আমার চেহারায় সেই বঞ্চিত বঞ্চিত ভাবটা আবারো ফিরে এসেছে।সালেহ ভাই তাঁর পাশেই আমাকে বসালেন।ঘটনা শুনলেন।তারপর তাঁর অন্যপাশে বসে থাকা প্রবীন এক ভদ্রলোকের সংগে অতি হাস্যমুখে আলাপ শুরু করলেন।এতোক্ষণ খেয়াল করিনি সালেহ ভাইয়ের পাশে বসা ভদ্রলোকটি আশরাফ সিদ্দিকী।ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী।বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক।ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকীকে সালেহ ভাই বললেন—আপনাদের এই কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান তো খুবই সুন্দর হচ্ছে!
--সালেহ তুমি ঠিকই বলেছো।এতো মানুষ কবিতা শুনছে!ভাবা যায়?
--কিন্তু এই সুন্দর অনুষ্ঠান আর সুন্দর থাকছে না......সালেহ ভাইয়ের কণ্ঠে দৃঢ় প্রত্যয়দৃপ্ত উচ্চারণ।শুনে যেনো নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না এমন ভঙ্গিতে মহাপরিচালক বললেন—কি বললে তুমি?
আগের চাইতে আরো গভীর নির্লিপ্ততায় রিপিট করলেন সালেহ ভাই--এই সুন্দর অনুষ্ঠান আর সুন্দর থাকছে না।
--কেনো, কি হয়েছে? সমস্যা কি?
আমাকে দেখিয়ে এইবার সমস্যাটা বয়ান করলেন সালেহ ভাই—এই যে আমাদের খুব প্রমিজিং ছড়াকার রিটন। ও এখানে ছড়া পড়তে চায়। দুইদিন আগে হুদার কাছে নাম নিবন্ধন করতে এসেছিলো। হুদার বাচ্চা ন্যায় নাই।বলেছে দেরী হয়ে গেছে।
--হ্যাঁ, হুদা তো ঠিকই বলেছে।আঠারো তারিখ পর্যন্ত সময় ছিলো।
--কিন্তু এদের ছড়া পড়তে দিতে হবে।
--এদের মানে? একটু আগে না বললা শুধু ওর কথা!
--হ্যাঁ, প্রথমে তো ও একাই ছিলো। এখন দশজন হয়ে গেছে।
--কিন্তু এটা কি করে সম্ভব সালেহ?কি করে সম্ভব?
সালেহ ভাই বললেন,--সম্ভব।আমার নাম তো হুদাকে ঘোষণা করতেই হবে, কারণ আমার নামের নিবন্ধন করা আছে। হুদা আমার নাম ডাকার পর আমি ছড়া পড়তে উঠে মাইকে এই যে এই তালিকাটা,(হাতের মুঠোয় ধরে রাখা কাগজের টুকরোটি দেখিয়ে) এই তালিকাটা পড়ে এদের সবাইকে একসঙ্গে মঞ্চে ডাকবো। আমার পরে এরা একে একে ছড়া পড়তে থাকবে।আমাকে বাঁধা দিতে গেলেই তো হুলুসস্থুল কাণ্ড বেঁধে যাবে।কারণ মাইক্রোফোন তো তখন আমার হাতে!এখন একবার দৃশ্যটা ভাবেন তো আশরাফ সিদ্দিকী সাহেব,মঞ্চে আমরা এগারোজন আর হুদার বাচ্চা হুদা......
হতভম্ব ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী ছড়াকার আবু সালেহর হাত থেকে তালিকাটা নিয়ে—কী যে ঝামেলা করো না তোমরা বলতে বলতে একটু ল্যাংচানো ভংগিতে হাঁটতে হাঁটতে মঞ্চের সামনে গেলেন। মহাপরিচালককে তাঁর আসন থেকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে মুহম্মদ নূরুল হুদা মঞ্চের শেষ সীমানার কাছে ঝুঁকে পড়লেন।মহাপরিচালক হাত নেড়ে নেড়ে কি সব বললেন। তারপর টুকরো কাগজে লেখা তালিকাটি তাঁর হাতে সমর্পন করলেন।এবং আধাবিষণ্ন আধা প্রসন্ন মুখে ফিরে এসে সালেহ ভাইকে বললেন—হুদা এখনি ডাকবে।যাও ছড়া পড়ো। কিন্তু একটার বেশি পড়বা না।কবিদের বিশাল লিস্টি নিয়া বসছে হুদা,হুদার মাথার ঠিক নাই এখন।
কিন্তু হুদার মাথা ঠিকই ছিলো।কারণ কিছুক্ষণ পরেই তিনি মাইকে ঘোষণা করলেন—এখন আমি কয়েকজনের নাম ঘোষণা করবো যাঁরা নিজেদের কবি নয়,ছড়াকার বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। এঁরা হচ্ছেন অমুক অমুক অমুক এবং লুতফর রহমান রিটন।প্রথমেই ছড়া পড়বেন......বলে তিনি তালিকার সবচে নিচে থাকা আমার নামটাই ঘোষণা করে বসলেন।
হারাধনের দশটি ছেলের কয়েকটা ইতোমধ্যে পরিস্থিতি অনুকুলে নয় বিবেচনা করে এদিক-ওদিক সটকে পড়েছিলো। আমি সবাইকে জড়ো করার সুযোগই পেলেম না,মাইকে আমার নাম ঘোষিত হয়ে গেছে।এক দৌঁড়ে মঞ্চে উঠে গেলাম।বাংলা একাডেমী লোকে লোকারণ্য।শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে পুলিশের নির্দেশিত পথ ধরে এগিয়ে এলে এমনিতেই বাংলা একাডেমীর সামনে দিয়েই যেতে হয়।আর যাবার সময় ভেতরে কি হচ্ছে তা দেখার কৌতূহলজনিত কারণে খামোখাই লোকজন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে বাংলা একাডেমীতে।বই কিনতে কিংবা কবিতা শুনতে আসেনা প্রায় কেউই।কিন্তু মঞ্চের সামনে সামিয়ানা আছে এবং ওখানে সারি সারি চেয়ার পাতা আছে সুতরাং হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত বাঙালি একটু জিড়িয়ে নিতে, পদযুগলকে একটু প্রশান্তি দেবার মানসে টপাটপ বসে পড়ে চেয়ারগুলিতে।আর সে কারণেই হাউজফুল পরিস্থিতি বাংলা একাডেমীর কবিতা পাঠের আসরটিতে।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ে দেখি গত ঘন্টা দেড়েকের উত্তেজনা আর টেনশনে আমার ছড়াটাই ফেলেছি হারিয়ে! কী আর করা। সম্প্রতি লেখা একটা ছড়া মুখস্ত ঝেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমবেত জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম—কনতো দেহি আইজকা দ্যাশে/সবচে শরীল তাজা কার?জনগণ জবাব দেবে কি আমিই জবাব দিলাম—যেই শালারা রাজাকার!
আর যায় কোথায়, লাইনটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন ফেটে পড়লো উল্লাসে।ওদের সমবেত উল্লাসধ্বনি আমার ভেতরের চেতনাগত স্পিরিটটাকে মুহূর্তেই গুণ গুণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো।অতঃপর আমি স্মৃতি হাতড়ে পরের পংক্তিটি আওড়ালাম—পাল্টে লেবাস কোন ব্যাটারা/আজ সমাজে পায় কদর?/যেই শালারা আলবদর!
বলবার সঙ্গে সঙ্গেই অভাবনীয় কাণ্ড!সমবেত জনতার উল্লাসধ্বনির ভেতরে দর্শক সারিতে সামনের আসনে বসে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক উঠে দাঁড়িয়ে করতালিতে ফেটে পড়লেন।আর তাঁর দেখাদেখি অন্যান্য আসনে উপবিষ্ট লোকজনও উঠে দাঁড়ালেন করতালি দিতে দিতে।সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।সামিয়ানার শেষ দিকটায় চলমান জনতার ভিড়টা দুধের সরের মতো ঘন হয়ে কেমন যেন থমকে গেছে।কেউ নড়ছে না,হাঁটছে না।
এরপর আমার ছড়ার পরের পংক্তি—গদির পাশে বইছে ক্যাডা?/পান খাওয়া মুখ যা লাল রে!—একাত্তুরের দাদাল রে।
পড়া মাত্রই হাজার হাজার মানুষের উল্লাস যেনো আর থামতেই চায়না।আমাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো।
অতঃপর পাঠ করলাম আমার ছড়ার শেষ স্তবক— আপনেরা কন ঊনাশিতে/আমরা অগো কি করুম?/--ভাইজা তেলে ঘি করুম!
মানুষের সে কী প্রতিক্রিয়া!মানুষের ভেতরের জমাট বাঁধা ক্ষোভ-ঘৃণা আর প্রতিরোধের চেতনাকে ছড়াটার ছন্দ আর বক্তব্য মিলে প্রবল এক ঝাঁকুনি দিয়েছে।দীর্ঘ দিনের পাথরচাপা সময় তাদের ভেতরে সৃষ্টি করেছিলো নৈরাশ্যের দমবন্ধ এক গুমোট পরিস্থিতির।সেই পাথরচাপা সময়ের আগল যেনো ভেঙ্গে গেলো।ওয়ান মোর ওয়ান মোর বলে ফেলেছিলো কয়েকজন কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির কথা চিন্তা করেই বোধ হয় বাক্যটার বাংলা অনুবাদ হয়ে গেলো দ্রুত—আবার পড়েন আবার পড়েন ধ্বনিতে।
এবং আমাকে পুনরায় পড়তে হলো ছড়াটা!
আমার পরে একে একে ছড়া পড়লেন আবু সালেহ,আমীরুল ইসলাম,আসলাম সানী,সৈয়দ আল ফারুক,সরকার জসীম,আবু হাসান শাহরিয়ার,আবদুর রহমান,আনওয়ারুল কবীর বুলু, সৈয়দ নাজাত হোসেন, খালেক বিন জয়েনউদ্দীন।প্রত্যেকেই মাতিয়ে রাখলেন সময়টা বিচিত্র সব বিষয়ের ওপর বৈচিত্র্যময় ছড়া পাঠ করে।আমাদের ছড়াকারদের পড়া শেষ হলে আবারো শুরু হলো কবিদের কবিতা পাঠ।প্রথমেই নাম ঘোষিত হলো জাহিদ হায়দারের।জাহিদ হায়দার তাঁর কবিতার কয়েকটি চরণ পড়ার পর দর্শকদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়লেন---ছড়া শুনতে চাই, ছড়া শুনতে চাই, আরো ছড়া......।পরিস্থিতি সামাল দিতে মুহম্মদ নূরুল হুদা ঘোষণা করলেন কবি আসাদ চৌধুরীর নাম।চমৎকার চেহারা অপরুপ কণ্ঠস্বর আর অসাধারণ বাচনভঙ্গির সমন্বয়ে আসাদ ভাই পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে ছোটোখাটো একটা বকৃতাও দিয়ে ফেললেন।আমাদের প্রতি বিপুল প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করে আসাদ ভাই বললেন—রিটনদের পরে কবিতা পড়তে যাওয়াটা খুবই বিপজ্জনক।বলেই আসাদ ভাই তাঁর অনন্যসাধারণ কণ্ঠ ও ভঙ্গিমায় ‘সত্য ফেরারী’ পাঠ করে দর্শক শ্রোতার মন জয় করে ফেললেন।পরিস্থিতি কবিদের আরো বেশি অনুকূলে নেবার দায়িত্ব এবং তাগিদে আসাদ ভাই পড়লেন আরেকটি কবিতা—ওদের হাতে ঘড়ি তো নেই সূর্য হলেন ঘড়ি/কয়েক ছটাক চালের ডালের/....মরিচ লবণ আনাজপাতির/ যোগাড়যন্ত্র করতে করতে করতে......(স্মৃতি থেকে লিখছি)।এই কবিতার শেষ শব্দ—করতে করতেটা আসাদ ভাই আপন কণ্ঠস্বরেই ইকো ইফেক্ট ইম্পোজ করলেন অপরূপ ক্যারিশম্যাটিক দক্ষতায়।এবং করতে করতে করতে করতে উচ্চারণ করতে করতে আসাদ ভাই মাইক্রোফোন থেকে মুখটা একটা নির্দিষ্ট রিদমে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিলেন।আর তাতে করে মনে হলো লোকটা মানে কবিতার সেই চরিত্রটা ক্রমশঃ অনেক দূরবর্তী কোনো পাহাড়ের গুহায় মিলিয়ে গেলো! আমি আমার পরবর্তী জীবনে আর কোনোদিন আসাদ ভাইয়ের এইরকম অলৌকিক জাদুকরী পারফরম্যান্স দেখিনি।কবিদের মর্যাদা রক্ষায় আসাদ ভাই সেদিন তাঁর সমস্ত মেধা এবং সর্বোচ্চ শক্তির প্রয়োগ করেছিলেন।সেই থেকে আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার চিরকালের খাতিরের একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেলো।কিন্তু মুহম্মদ নূরুল হুদার সঙ্গে সম্পর্কটা আর ব্যাটে-বলে হয়নি, হলো না।যদিও একটা মর্যাদাপূর্ণ হাই-হ্যালোর দূরত্ব আমরা মেইনটেইন করে যাচ্ছি আজও।
ছড়া প্রসঙ্গে ফিরে যাই।আমরা ছড়াকাররা ছড়া পাঠ শেষে মঞ্চ থেকে বিজয়ীর বেশে নেমে এলাম।মুহম্মদ নূরুল হুদা আমার দিকে ভালো করে তাকালেন না পর্যন্ত।আর পাবলিক যে কতোরকম ভাবে তাদের ভালোলাগা আর ভালোবাসা প্রকাশ করলো! সে আরেক কাহিনী।
সালেহ ভাই মহা খুশি।বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী আমাকে লোক মারফত ডেকে নিয়ে বললেন—তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়ে কয়েকদিন পরে এসে একটা চেক নিয়ে যেও।
আমি তো অবাক,--কিসে চেক স্যার?
তিনি বললন—এইটা লেখক সম্মানী।
সপ্তাহ খানেক পর নূরুল হুদার নাকের ডগা দিয়ে একশো (নাকি পঁচাত্তর!) টাকার একটা চেক নিয়ে এলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন