রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১১

ছড়া এবং ফারুক হোসেন


ছড়া এবং ফারুক হোসেন

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী

 

 









ফারুক হোসেন

অগ্রজ ফররুখ আহমদ, রোকনুজ্জামান খান, ফয়েজ আহমদ, এখলাসউদ্দিন আহমদ, আফলাতুন, রফিকুল হক, আল মাহমুদ প্রমুখের পদরেখায় সে সময় খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, মুস্তফা মহিউদ্দিন, শাহাবুদ্দিন নাগরী, আবদুর রহমান, আবু হাসান শাহরিয়ার, সৈয়দ আল ফারুক, লুৎফর রহমান রিটন ও আমীরুল ইসলাম যুক্ত হয়েছেন।


১৯৭০ দশকে ফারুক হোসেন বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেছিলেন স্থির মনোনিবেশ নিয়ে। শুরুতেই তিনি ছোটদের জন্য লিখবেন বলে মনস্থির করেছিলেন এবং গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে এই সিদ্ধান্তে অটল থেকে লিখে গেছেন। ফলে তাঁর রচনাবলির অভিমুখে পরিলক্ষ হয় নিষ্ঠাজ্ঞান।  উপরন্তু  ধারাবাহিক অনুশীলন তাঁর রচনাকে ক্রমান্বয়িক সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর করে নিয়ে গেছে। কখনো কখনো তিনি গদ্য লিখলেও তাঁর মূল বিচরণ ক্ষেত্র ছড়া। ছড়ার অঙ্গনে তাঁর বিচরণে স্বাচ্ছন্দ্য পরিলক্ষিত হয়। কালসচেতনতা তাঁর ছড়াকে শিশু সাহিত্যের বলয়মুক্ত করে সর্বজনীন করে তুলেছে।                               
পৃথিবীর সব সাহিত্যেই ছড়ার উদ্ভব ও বিকাশ প্রত্যক্ষ হয়। এর একটি কারণ এই হতে পারে যে ছড়া লেখ্য ভাষার ওপর নির্ভরশীল নয়। বর্ণমালা আবিষ্কারের আগে যখন কথাসাহিত্যের অবকাশ ছিল শূন্য অথবা সীমিত তখনও ছড়ার সম্ভাবনা ছিল অবারিত। তবে এই সম্ভাবনার দুটি সীমারেখা ছিল। মৌখিক রচনার ক্ষেত্রে যেমনটি স্বাভাবিক, ছড়ার অবয়ব খুব প্রসারিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে মানুষের মুখে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত ছড়ার অভিব্যক্তি ছিল অনুষঙ্গলগ্ন ; ছড়া ছিল উপস্থিত কোন ঘটনার প্রত্যুত্তর। “খনা বলে ডেকে যান / রোদে ধান ছায়ায় পান” ইত্যাদি খনার বচনে যে তাৎক্ষণিকতা পরিলক্ষিত হয় ১৯৭০-এর দশকে আবু সালেহ রচিত “ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা / রক্ত দিয়ে পেলাম শালার কেমন স্বাধীনতা” তারই ধারাবাহিকতা বললে ভুল হয় না। এমনকী ইংরেজী ভাষার পাঁচ লাইনের লিমেরিকেরও জাত-পাতে মৌখিক।                          
বর্ণমালার আবিষ্কার ছড়াকে দুটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। প্রথমত: স্মৃতিনির্ভরতা দূর হওয়ায় দীর্ঘ ছড়া লেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত: ছড়া মানুষের সুচিন্তিত অভিব্যক্তি হিসাবে আবেগ, উপলব্ধি, বিবেচনা প্রভৃতির সমবায়ে একটি মননশীল সৃষ্টিকর্মে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অবারিত হয়েছে। তবে এর ফলে ছড়া ও কবিতার সীমারেখা ধূসর হয়ে উঠেছে কখনো কখনো। অনেক রচনা ছড়া না কবিতা তা সুনিশ্চিতভাবে নিরূপণ করা হয়ে পড়েছে দুরূহ।                                           
পাঠ্যসাহিত্য হিসেবে উপন্যাসের আবিষ্কার নাটককে যেমন ছায়ান্তরালে ঠেলে দিয়েছে তেমনি আধুনিক কবিতার আবিষ্কারের পর বিংশ শতকে ছড়ার চর্চা হ্রাস পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে ইয়োরোপীয় সাহিত্যে নার্সারী রাইমসের বাইরে ছড়ার চর্চা সম্প্রতিকালে সীমিত। তবে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে চিত্রটি বেশ ভিন্ন। প্রকৃত অবস্থা এই যে বাংলা ছড়া গত একশত বছরে একটি পৃথক সাহিত্য-মাধ্যম হিসাবে দৃঢ়মূল আসন করে নিয়েছে। এই আসন গভীর, এর ব্যাপ্তি সুপ্রসার। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছড়ার কাঠামো নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ খাপছাড়া বিচিত্র ছড়ায় ঋদ্ধ। বুদ্ধদেব বসুর লেখায় সুকুমার রায়ের ছড়া ‘হাসির কবিতা’ হিসাবে চিহ্নিত হলেও আবোল তাবোল উৎকৃষ্ট ছড়ারই আঁকড়। কেবল ছড়াকাররা নন, বড় মাপের কবিদের অনেকেই শিশুতোষ রচনা হিসেবে ছড়া লিখেছেন। বাংলা ছড়ার ভা-ার আজ সমৃদ্ধ। শিশুসাহিত্যের একটি প্রধান ধারা হিসেবে বাংলা ছড়া স্বীকৃত এবং ক্রমবিকাশমান।
২বাংলাদেশে সত্তর দশক আত্মবিশ্বাসী কবি ও ছড়াকারদের আবির্ভাব ও ডানাবিস্তারের স্বর্ণকাল। এ সময় ফারুক হোসেন যখন ছড়া লিখতে শুরু করেছিলেন তখন তাঁর সামনে ছিল ছড়ার একটি দৃঢ়মূল ঐতিহ্য, আবহাওয়া ছিল মনোযোগী চর্চায় ঋদ্ধ, সোনালি ফসলের ঘ্রাণ চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল প্রবল উদ্দীপনা। অগ্রজ ফররুখ আহমদ, রোকনুজ্জামান খান, ফয়েজ আহমদ, এখলাসউদ্দিন আহমদ, আফলাতুন, রফিকুল হক, আল মাহমুদ প্রমুখের পদরেখায় সে সময় খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, মুস্তফা মহিউদ্দিন, শাহাবুদ্দিন নাগরী, আবদুর রহমান, আবু হাসান শাহরিয়ার, সৈয়দ আল ফারুক, লুৎফর রহমান রিটন ও আমীরুল ইসলাম যুক্ত হয়েছেন। তাদেরই সতীর্থ হিসেবে ফারুক হোসেনের প্রবেশ ছড়ার ভুবনে। সময়টি একদিকে ছিল সীমাহীন প্রেরণায় উদ্ভাসিত; অন্যদিকে কঠিন প্রতিযোগিতার আশংকায় সদাকম্প্র। আত্মপ্রত্যয় ফারুক হোসেনকে এগিয়ে নিয়েছিল, তিনি সহযোগিতা পেয়েছিলেন স্বভাবী বুদ্ধিদীপ্ত বিষয়জ্ঞানের। একটি রচনায় তিনি ছড়ার কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন যা প্রণিধানযোগ্য :


                                                               [...] যেখানে শব্দ চাল
                                                                      মিষ্টি বা টক ঝাল
                                                                      ঢের কথা অল্পতে পড়া,
                                                                       তারই নাম ছড়া।

                                                                       ভাষা যার খুব সোজা
                                                                       চট করে যায় বোঝা
                                                                       পড়ে যেনো জাগে ঘাটে মড়া,
                                                                       তারই নাম ছড়া। ...                               [পৃ. ৯ ]

এই বৈশিষ্ট্যগুলো স্বকৃত ছড়ায় তিনি বজায় রেখেছেন। এই যে “ঢের কথা অল্পতে পড়া” এটি তাঁর সাহিত্যচেতনার অন্যতম নীতিচিহ্ন। তবে এ বৈশিষ্ট্য অভিনব নয়। “ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে / বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কী সে”- কেবল এই দুই পঙক্তিতে যে অসামান্য দক্ষতায় বাংলার ইতিহাসকে ধারণ করা হয়েছে তা অবিস্মরণীয়। এই কাজটি ছড়া পারে ; সামান্য দিয়ে অবলীলায় অসামান্যের দ্যোতনা সৃষ্টি করতে পারে। ছড়ার গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের এটি অন্যতম সোনালি রেখা।
ফারুক হোসেনের প্রথম গ্রন্থ লুটোপুটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪-তে। ২০০৯ পর্যন্ত তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ৩০। শতরকমের ছড়া তাঁর অন্যতম সংকলন গ্রন্থ যাতে তিনশত ছাপ্পান্নটি ছড়া সংগ্রন্থিত হয়েছে। ২০০৪ পর্যন্ত প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত সংকলন এটি। এই প্রতিনিধিস্থানীয় সংকলনটি থেকে তাঁর মেজাজ ও কাব্যরুচির পরিচয় পাওয়া সম্ভব। নাগাড়ে ছড়াগুলো পড়ে গেলে দৃষ্টি এড়ায় না যে সমাজসচেতনতা তাঁর বিষয় নির্বাচনের অন্যতম উৎসভূমি। একদিকে আছে এইডস থেকে ওর‌্যাল স্যালাইন আর আর্সেনিকদূষণ; অন্যদিকে আছে বেহাল দশার বিআরটিসি বাস থেকে ঢাকা নগরীর আধুনিকায়নের ফিরিস্তি। ফারুক হোসেনের ছড়ার বিষয় নির্বাচনের সময় সমাজমনস্কতা অগ্রাধিকার পেয়েছে।


সমাজকে উপস্থাপন করা কবি-লেখকের আবশ্যিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। প্রধানত সে রকম কোনো দায়িত্ববোধ থেকে ছড়া লিখেছেন ফারুক হোসেন এরকম সিদ্ধান্তে আসাও সমীচীন হবে না। তবে তাঁর রচনাবলিতে নিখুঁত সমাজচিত্র প্রত্যক্ষ হয় যা উল্লেখযোগ্য বটে। তিনি আর সবার মতো সমাজে বসবাস করেন, অনাচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন যা কিছু ঘটে যায় চারপাশে। সেই ঘটনাগুলো তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। এইখানে লক্ষ করা যায় তাঁর দৃষ্টিকোণ নৈর্ব্যক্তিক। যেমন ‘রেজকি’ নামের ছড়াটিতে মুদ্রাস্ফীতির ফলে খুচরো পয়সা অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠার বিষয়টি উঠে এসেছে সুন্দরভাবে। এখানে মুদ্রাস্ফীতিকে ব্যঙ্গ করা লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য নিছক উত্থাপন করা যে পকেটভর্তি খুচরো পয়সা নিয়ে আজকাল কিছু আর কেনা যায় না ; খুব বড়জোর ফকির বিদায় করা যায়।
একজন কবির পক্ষে সকল কবিতাকে নিখুঁত ও মনোগ্রাহী করে রচনা করা সম্ভব হয় না। জীবৎকালে দশটির বেশি স্মরণীয় কবিতা লিখেছেন এরকম কবির সংখ্যা কেবল বাংলাদেশে নয় সারা পৃথিবীতেই কম। একটি কবিতা স্মরণীয় হওয়ার পেছনে অনেকগুলো শর্তগুচ্ছ কাজ করে যার প্রধান দুটি যথাক্রমে শিল্পশর্ত ও পাঠকের রুচিসম্মতি। একই সঙ্গে এ দুটি শর্তগুচ্ছ পূরণ করা সহজ নয়। ছড়ার ক্ষেত্রে এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য। ফারুক হোসেনের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় তিনি সার্থক হয়েছেন তখনই যখন স্বতঃস্ফূর্ততা ও ছন্দোময়তার আনন্দঘন সন্নিপাত হয়েছে। ‘শোলক’ ছড়াটির প্রথম স্তবকটির প্রতি এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়:

                                                       [...] এদিক ওদিক দুললে যদি   
                                                              দোলনা বলো তাকে,
                                                              দোলনা বলা হয় না কেন
                                                              ঘড়ির দোলকটাকে ? .. .                             [পৃ. ১০ ]

এরকম বহু ছড়াতেই প্রত্যক্ষ হয় খুব সহজিয়া রীতির অনায়াস গাঁথুনি। ছন্দ হিসেবে স্বরবৃত্তই ছড়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাহন। ফারুক হোসেনের ছড়া সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। বিষয়বস্তুর আকর্ষণীয়তা, স্বরবৃত্তের নিখুঁত দোলাচল আর যথাশব্দের প্রয়োগেই ছড়া হয়ে ওঠে মনোজ্ঞÑএই ত্রিবিধ শর্তপূরণ তাঁর বেশ কিছু ছড়াকে স্মরণীয় করে তুলেছে। ‘সমন্বয়’ ছড়াটির একটি স্তবক এরকম:

                                                       [...] ঘড়ির ভেতর তিনটি কাঁটা
                                                             নেই প্রয়োজন ফিরিস্তির
                                                            একটি ঘোরে ভীষণ জোরে
                                                            একটি চলে ধীর স্থির। ...                                [পৃ. ১৪২]

এরকমই আরেকটি উদাহরণ ‘পোলিও’ শীর্ষক ছড়াটি। ফারুক হোসেন একটি নিতান্ত কেজো বিষয়কে আবৃত্তিযোগ্য একটি ছড়ায় রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছেন নিপূণ দক্ষতায় : 

                                                       [...] গায়ে জ্বর খুব, গলা ব্যথা আর
                                                              বমি বমি ভাব আছে
                                                              খেলাধূলা আর দৌড়ানো ভালো
                                                              লাগে না দীপুর কাছে। ...                                [পৃ. ১৭৯]

ওপরের ‘সমন্বয়’ ছড়াটি আবার একটু দেখা যেতে পারে। ‘ফিরিস্তির’ সঙ্গে ‘ধীর স্থির’ এর মিল অভিনব। এধরনের অন্ত্যমিল ছড়ার গাঁথুনিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। তবে বলা দরকার এ-রকম অভিনব অথচ লাগসই মিল যে কোনো ছড়াকারের জন্য ভাগ্যের বিষয়। একটি পঙক্তি রচনার পর আরেকটি সমিল পঙক্তি রচনার ক্লেশকর অভিজ্ঞতা কেবল ভাগ্যের জোরেই এড়ানো সম্ভব। এহেন সৌভাগ্যকে সচরাচর ‘প্রতিভা’ বলেই উল্লেখ করা হয়।
বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে একজন ছড়াকারের সামনে অন্তত: তিনটি বিকল্প থাকে। উপর্যুক্ত ‘পোলিও’ ছড়াটি একটি বিশেষ পস্থার উদাহরণ যাতে একটি বাস্তব বিষয়কে দক্ষতার সঙ্গে ছন্দায়িত করা হয়েছে। এখানে ভিন্নতর কোনো উদ্দেশ্য রচয়িতার নেই। এরকম ছড়ার আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘সিট সমাচার’ :

                                               [...] যাত্রী বোঝাই ব্যাপক হারে
                                                     সিট খালি নেই ইস্টিমারে
                                                     লঞ্চে বাসে রেল  বা কারে
                                                     টেম্পো মিনিবাসে
                                                     যাত্রীরা হায় তাই নিরূপায়
                                                     দাঁড়িয়ে যায়, আসে।

                                                     অফিস পাড়ায় তালবাহানা
                                                    -‘সিট খালি নেই’, চাকরি মানা
                                                     শূন্য সিটের অন্বেষণে
                                                     ঘর ছেড়ে যায় দূরে,
                                                     অফিস পাড়ায় লক্ষ যুবক
                                                      হচ্ছে ভবঘুরে। ...                                         [পৃ. ৭৩]

এ ধরনের ছড়ায় প্রতিপাদ্য বিষয়টি মুখ্য ; তাই নিখুঁত ছন্দে, উপযুক্ত শব্দচয়নে, বক্তব্যের অভিনব বিন্যাসে একে শ্রুতিমধুর করবার দায়িত্ব সম্পর্কে ছড়াকারকে সজাগ থাকতে হয়। তা না হলে এ ধরনের ছড়া গদ্যের অদক্ষ রূপান্তরের উদাহরণে পর্যবসিত হতে পারে। উদ্ধৃত ছড়াটিতে শব্দচয়নে, পদসংস্থাপনার ক্রমে এবং ছন্দবিন্যাসে ফারুক হোসেনের মুন্সিয়ানা লক্ষ করা যায়। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, এ-ধরনের ছড়া রচনা তাঁর প্রিয় একটি কৌশল। এভাবেই সমাজের নানা প্রিয়-অপ্রিয় প্রসঙ্গ তাঁর ছড়ার প্রতিপাদ্য হয়ে উঠে এসেছে।
দ্বিতীয় যে বিকল্পটি সচরাচর পরিলক্ষিত হয় তা হল পরিচিত কোনো বিষয়ানুষঙ্গের ওপর ভিত্তি করে হাস্য-রস, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ বা কৌতুকাবহ সৃষ্টি করা। এরকম ছড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ। বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার শক্তি যুক্ত হওয়ায় পাঠককে সজোরে আন্দোলিত করার ক্ষমতা রাখে এই ছড়া। ফারুক হোসেনের ‘খাচ্ছি অনেক’ নামীয় ছড়াটি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়:

                                                    [...] চাইলে খাবার যায় না পাওয়া
                                                           খাচ্ছি তবু অনেক খাওয়া
                                                           খাচ্ছি অনেক পেট ভরে না
                                                           তাতেও কিছু যায় আসে না।
                                                           খাচ্ছি হাওয়া খাচ্ছি ধোঁয়া
                                                           খাচ্ছি কেবল থতমত
                                                           খাচ্ছি ধোলাই বাড়ছে ক্ষত।
                                                            ডিগবাজি খাই ঢোক গিলে খাই
                                                           দোলনাতে খাই দোল,
                                                           চোখ খেয়েছি কান খেয়েছি
                                                           খেলতে খেলাম গোল। ...                                [পৃ. ১৮২]

তৃতীয় যে আঙ্গিকটি ছড়াকারকে প্রলুব্ধ করে তা হল অর্থহীন, কিংবা বলা যায় অর্থমুক্ত, ছড়া। এরকম ছড়া যে পুরোপুরি অর্থহীন তা আদৌ নয়, কিন্তু অর্থ বা তাৎপর্য এর মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। অন্যান্য রূপ ছড়ায় বক্তব্যের যে যুক্তিশীল বা ধারাবাহিক বিন্যাস পরিলক্ষিত হয় তা এরূপ ছড়ায় অনুপস্থিত। তদস্থলে পাওয়া যায় শ্রুতিমধুর শব্দক্রীড়া। একটি পঙক্তির সঙ্গে আরেকটি পঙক্তির প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা বা সংশ্লিষ্টতা দৃষ্টিগোচর হয় না; কেবল ছড়াকারের জাদুস্পর্শে আপাত অর্থহীন বা বিচ্ছিন্ন বিষয়াবলি লাভ করে একটি অখ- অবয়ব। দৃষ্টি এড়ায় না যে ফারুক হোসেনের কাছে এ আঙ্গিকটি প্রশ্রয় লাভ করে নি।  সম্ভবত অন্তর্গত যুক্তিশীলতাই এর কারণ।
এই যুক্তিশীলতার কারণেই ফারুক হোসেনের অধিকাংশ ছড়া বিষয়মুখী, অর্থসমৃদ্ধ। এটি তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্যও বটে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর সমাজমনস্কতা। ফলে তাঁর ছড়াসমগ্র কার্যত সমসাময়িক বাংলাদেশের বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবি। তিনি নীতিনিষ্ঠ ছড়াকার কিন্তু নিছক শিশুসাহিত্যিক নন। তাঁর রচনা শিশুদের দিগন্ত ছাড়িয়ে সর্বজনীনতার আকাশ স্পর্শ করেছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন