বাংলা সাহিত্যের একটি শক্তিশালী শাখা হলো ছড়া। প্রাচীন যুগে ‘ছড়া’ সাহিত্যের মর্যাদা না পেলেও বর্তমানে সে তার প্রাপ্য সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এখনও অনেকেই ছড়া সাহিত্যকে শিশু সাহিত্যেরই একটি শাখা মনে করেন কিংবা সাহিত্যের মূল ধারায় ছড়াকে স্বীকৃতি দিতে চান না, তবুও অসংখ্য ছড়াকারের প্রচেষ্টাতে ছড়া এখন বাংলা সাহিত্যের এক শানিত উচ্চারণ, বলিষ্ট প্রতিনিধি। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছড়াকে স্থান না দিলেও ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিদিনের আয়োজনে ছড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ ছড়াকে ‘কবিতা’ বলার পাশাপাশি আধুনিক গদ্য কবিতার যুগে এসব মিলযুক্ত কবিতা বা পদ্যের অবস্থানকে হালকা করে দেখা সত্ত্বেও ছড়া সাহিত্যের গতিপথে তেমন কোন ব্যাঘাতই সৃষ্টি হয়নি। বরং তাদের এসমস্ত অবজ্ঞার কারণে ছড়াকারদের চেতনাবোধ আরো জাগ্রত হয়েছে, এগিয়ে গেছে ছড়া আন্দোলন।
ছড়া প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা অর্থেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মধ্যে। সেই জন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।’ এক সময় ছড়াকে মনে করা হতো শুধুই শিশু সাহিত্য। তবে এখন আর তা মনে করা হয় না, বাংলা সাহিত্যে ছড়া তাঁর নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। এখন ছড়াকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা হয়। **যেমন- শিশুতোষ ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া, ছড়ার ছন্দাশ্রিত কিশোর কবিতা প্রভৃতি। এর মধ্যে শিশুতোষ ছড়া তৈরি হয় কেবলমাত্র শিশু-মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। এ জাতীয় ছড়ায় ব্যবহৃত শব্দ বা বাক্যের অর্থ থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। যেমন- ‘হাট্টিমাটিম টিম/ তারা মাঠে পাড়ে ডিম/ তাদের খাড়া দুটো শিং…./ তারা হাট্টিমাটিম টিম’।কিংবা- ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে/ ঢাল মৃদঙ্গ ঘাঘর বাজে’।অথবা- ‘বাকবাকুম পায়রা/ মাথায় দিয়ে টায়রা/ বউ সাজবে কাল কি? চড়বে সোনার পালকি?’ প্রভৃতি। এসব ছড়া শিশুদের কল্পলোকে নিয়ে যায় অনেকটাই রূপকথার গল্পের মতো। বাস্তবে হাট্টিমাটিম টিম কিংবা আগডুম বাগডুম বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই! কোন কোন ছড়া আবার একই সাথে শিশুদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি বড় ধরনের রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক চিত্র অংকন করে থাকে। কিংবা প্রতিবাদী চেতনা জাগ্রত করে জনতার মনে। যেমন-‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি/ খোকন গেল কার বাড়ি/ আয়রে খোকন ঘরে আয়/ দুধমাখা ভাত কাকে খায়’। এখানে সাধারণ দৃষ্টিতে যে চিত্র ফুটে ওঠে তা হলো এক মা তার ছোট্ট খোকার জন্য ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু খোকন সোনা অন্যের বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সেই দুধমাখা ভাত এসে কাকে খেয়ে ফেলছে। এই চিত্রটি শিশুদের মনোরঞ্জনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। শুধুমাত্র এই চারটি লাইনই একটি পূর্ণাঙ্গ শিশুতোষ গল্পের বিকল্প স্থান দখল করতে সক্ষম। অন্যদিকে এই ছড়ার মূল ভাবটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ছড়াকার এখানে দেশের যুবসমাজকে আহ্বান করছেন। এখানে ‘দুধমাখা ভাত’ বলতে দেশের সম্পদ এবং ‘কাক’ বলতে বিদেশী বেনিয়াদের বুঝানো হয়েছে। ছড়াটি বৃটিশ আমলের লেখা, তাই এর ভাবার্থ বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। আরেকটি জনপ্রিয় শিশুতোষ ছড়া দেখুন- ‘ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এল দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিব কিসে?’ শিশু মনোরঞ্জনের পাশাপাশি এই ছড়াতে নবাব আলীবর্দির আমলে মারাঠা কর্তৃক সাবেক বাংলায় লুটতরাজের চিত্র লক্ষ্য করা যায়। নবাব আলীবর্দির বয়স কম করে হলেও তিনশ বছর তো হবেই। তাহলেই ভাবুন, সেই তিনশতাধিক বছর থেকে বাংলা সাহিত্যে ছড়া কিভাবে মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে! শিশুতোষ ছড়া তাই কোন কোন সময় শুধুমাত্র শিশুদের জন্য রচিত হয় আবার কোন কোন সময় শিশুতোষ ছড়াতেই লুকিয়ে থাকে বড়দের জন্য বড় ধরনের সামাজিক চেতনা।
রাজনৈতিক ছড়াকে অনেকেই সাময়িক বা ক্ষণস্থায়ী বলে থাকেন। কারণ কোন নির্দিষ্ট সরকারের বা কোন মন্ত্রী এমপির দূর্নীতির চিত্র ছড়ায় অংকিত হলে তা সাময়িকভাবে মানুষের মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি করলেও সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব ছড়ার আবেদন ফুরিয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ আশির দশকের স্বৈরাচার বিরোধী অনেক ছড়াই এখন আর পাঠ করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে একথাও মানতে হবে যে, এসব ছড়ায় সংশ্লিষ্ট সময়ের একটি রাজনৈতিক চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় যা পরবর্তী যুগের লেখকদের গবেষণার বিষয়ও হতে পারে। ‘সাহিত্যকে সমাজের আয়না বলা হয়’ এ কথাটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ ছড়াকার আবু সালেহ এর ‘পল্টনের ছড়া’ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের একটি চিত্র দেখা যেতে পারে। ছড়াকার কোন প্রকার রাখঢাক না করেই স্পষ্ট উচ্চারণ করছেন, ‘ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা!/ যার পিছনে জানটা দিলাম যার পিছনে রক্ত/ সেই রক্তের বদল দেখ বাঁচাই কেমন শক্ত!/ ….বাঁচতে চেয়ে খুন হয়েছি বুলেট শুধুই খেলাম/ উঠতে এবং বসতে ঠুকি দাদার পায়ে সেলাম!/ ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা!’
শিশু এবং কিশোর দু’টি আলাদা শব্দ হলেও আমরা অনেক সময় ‘শিশু-কিশোর’ বলে তাদের একত্রিত করে ফেলি ৭/ ৮ বছর বয়সের একটি শিশুর মনমানসিকতা আর ১৩/১৪ বছর বয়সের একটি মন মানসিকতা কখনোই সমান হতে পারে না। অথচ আইনের দৃষ্টিতে অভ্যস্থ হয়ে আমরা সাধারণত: ১৮ বছরের কম বয়সী সবাইকেই শিশু মনে করে থাকি। অনেক গল্প উপন্যাস কিংবা সিনেমা নাটকে ১৮+ বলে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করা থাকে যাতে পাঠক মাত্রই বুঝতে পারে এটা প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য। বয়স দিয়ে শিশু এবং কিশোরের সীমারেখা আলাদা করা বেশ জটিল। সংস্কৃত শ্লোকে ছেলেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত লালন, দশ বছর পর্যন্ত তাড়ন এবং ষোল বছর প্রাপ্তিতে বন্ধুর মতো আচরণ করতে বলা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে সাত বছর বয়সে শিশুকে নামাজ পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে এবং দশ বছর থেকে নামাজ পড়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি করতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র প্রমুখ পন্ডিতগণ তেরো- চৌদ্দ বছরের ছেলেকে কিশোর বলেছেন। সবমিলিয়ে আমরা বারো বছর পর্যন্ত ‘শৈশব’ এবং তেরো থেকে উনিশ বছর পর্যন্ত ‘কৈশোর’ বলতে পারি। ইংরেজিতেও থারটিন টু নাইনটিন বয়সীদের ‘টিনেজার’ বলা হয়ে থাকে। ছড়ার ছন্দাশ্রিতা কিশোর কবিতাগুলো তাই মূলত: এই টিনেজারদের জন্যই রচিত হয়। এগুলোকে কেউ কেউ ‘ছড়া-কবিতা’ নামেও চালিয়ে দেন। এসব ‘ছড়া-কবিতা’ বা ‘কিশোর কবিতা’ বিষয়ধর্মী ও বক্তব্য প্রধান হয়ে থাকে। তবে এসব কবিতায় ব্যবহৃত হয় ছড়ার ছন্দ। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কিংবা শামসুর রাহমান-আল মাহমুদের অনেক ছড়াই তাই ছড়াত্ব না হারিয়েও কবিতার মর্যাদা লাভ করেছে। যেমন- রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘ওরে সবুজ ওরে অবুঝ ওরে আমার কাঁচা/ আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’।নজরুলের ‘লিচু চোর’ কিংবা ‘ভোর হল, দোর খোল খুকুমনি ওঠ রে/ ওই ডাকে জুঁই শাখে ফুল খুকি ছোট রে’।অনুরূপ ভাবে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের অনেক লেখাই একদিকে ছড়া, অন্যদিকে কবিতা।
‘ছড়া’ নিয়ে গবেষণা চলছে যুগ যুগ ধরে। ছড়া সাহিত্যের তাত্ত্বিক আলোচনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে অগ্রণী পুরুষ বিবেচনা করা হয়। তাঁর মতে, ‘গাম্ভির্য নয়, অর্থের মারপ্যাঁচ নয়, সুরময় ধ্বনিই ছড়ার প্রাণ’।ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছড়াকে বিজ্ঞান সম্মতভাবে বিচারের জন্যে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, ‘লোক বিজ্ঞানের একটি জনপ্রিয় শাখা ছড়া….’।প্রখ্যাত ছড়া সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় এর মতে, ‘ছড়া লেখার উপকরণ আসে সমসাময়িক ঘটনা বা পরিস্থিতি থেকে…’। তিনি আরো বলেন, ‘কোনটা ছড়া কোনটা ছড়া না এর কোন পাকা কষ্টি পাথর নেই। তবু….. কান দিয়ে যাচাই করতে বলব। সেই সংগে মেজাজ দিয়ে। ছড়ার মেজাজটা কৌতুকের। …… ছড়ার প্রাণ হচ্ছে ফান……’।ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর ‘আবহমান বাংলা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘ছড়া শুধু সমাজ-সংসার নিয়েই বলে না, দেশ ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বলে’।বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক ও ছড়াকার রোনুজ্জামান খান তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কবিতার বক্তব্য বুঝতে একটু চিন্তা করতে হয়। কিন্তু ছড়া পাঠের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে ওঠে’। সব মিলিয়ে বলা যায় ছড়ার একটি স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে বাংলা সাহিত্যে। সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন দৈনিকে ‘আজকের ছড়া’ শিরোনামে প্রতিদিন সমসাময়িক ঘটনার উপর ছড়া প্রকাশ করছে। সাপ্তাহিক ফান ম্যাগাজিনেও প্রাধান্য পাচ্ছে ছড়া। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছড়া আবৃত্তির অনেক সংঘ বা প্রতিষ্ঠান। ছড়া আবৃত্তি হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। এমনকি কেবলমাত্র ছড়া আবৃত্তির অনুষ্ঠানও হচ্ছে। অনুষ্ঠিত হচ্ছে ছড়া আবৃত্তি সন্ধ্যা, ছড়া পাঠের আসর। শুধু তাই নয় জাতীয় এবং স্থানীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে ছড়া সম্মিলনীসহ ছড়া সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনুষ্ঠান। ছড়াকে সুরারোপিত করতেও দেখা যাচ্ছে, বাদ্যি বাজনার তালে পাঠ হচ্ছে ছড়া। ছড়া অবলম্বনে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে পরিবেশিত হচ্ছে নৃত্য। শিশু শিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশিত হচ্ছে ছড়াগান। তাই ছড়াকে এখন আর অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই।
একসময় ছড়াকে ঘুম পাড়ানোর হাতিয়ার মনে করা হতো। মা তার ছোট্ট শিশুকে গুনগুনিয়ে ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। আর এখন ছড়াকে ঘুম তাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবেও চিহ্নিত করা হচ্ছে। বর্তমান সময়ের একজন স্বনামধন্য কবি (সুরমা পারের কবি হিসেবে খ্যাত) দিলওয়ার তাঁর এক ছড়ায় বলেছেন-
‘ছড়া নয় পানি পড়া/ নয় কোন মাদুলী,/ সে তো নয় ভিখারীর/ আনা সিকি আধুলি।/ ছড়া বয় রক্তের কণাতে/ অপমানে ফুঁসে ওঠে ফণাতে।/ অনলস সংগ্রামী আশাতে/ এক জোট মানুষের ভাষাতে,/ ছড়া তাই ঘরে ঘরে বিপ্লব/ অগ্রণী জনতার উৎসব’।
আজকাল অনেকেই ছড়াকে হালকা করে দেখেন। গদ্য কবিতা লিখে রাতারাতি কবিখ্যাতি পাওয়াটাই হয়তো তাদের লক্ষ্য। অনেকেই দেখা যায় শুরু করেন ছড়া দিয়ে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছড়ার সাথে সম্পর্কটা ধরে রাখেন না। ফলে তাঁদের অনেককেই ‘ছড়াকার’ কিংবা ‘কবি’ কোন উপাধিতেই সম্বোধন করা যায় না! আবার অনেককেই ইদানিং গদ্য কবিতার মতো ‘গদ্য ছড়া’ রচনার প্রয়াস চালাতে দেখা যায়। তাদের এসব প্রচেষ্টা দেখে হাসি পায়। ছন্দমিলই যদি না থাকে তাহলে ‘ছড়া’ হবে কি করে? বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কবিতার পাশাপাশি তাই ছড়াও একটি অনিবার্য শাখা বা মাধ্যম হওয়া উচিত। ছড়াকে কোন অবস্থাতেই হালকা করে দেখা উচিত নয়। একটি স্বার্থক, কালজয়ী ছড়া লিখতে পারা শত শত ব্যর্থ কবিতা লেখার চেয়েও উত্তম।
রাজনীতি ও সমাজ সংস্কারে ছড়া যে কতটা প্রতিবাদী চেতনা জাগ্রত করতে পারে তার কিছু চিত্র এখানে তুলে ধরছি।আল মাহমুদের ‘উনসত্তরের ছড়া’ বাংলা সাহিত্যে চিরায়ত ছড়া (মানুষের মুখে মুখে ঘুরে যে সকল ছড়া) হিসেবে স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। হবে নাই বা কেন? কী আক্রমণাত্মক ও লক্ষ্যভেদী তাঁর উচ্চারণ- ‘ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ শুয়োর মুখো ট্রাক আসবে/ দুয়োর বেঁধে রাখ।/ কেন বাঁধবো দোর জানালা/ তুলবো কেন খিল?/ আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ ফিরবে সে মিছিল।/ ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ ট্রাকের মুখে আগুন দিতে/ মতিয়ুরকে ডাক।/ কোথায় পাবো মতিয়ুরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে!/ তোরাই তবে সোনামানিক/ আগুন জ্বেলে দে!’
একই ভাবে নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শাহাবুদ্দীন নাগরীর কণ্ঠ উচ্চকিত হয় এভাবে- ‘‌এইতো সেদিন, দিব্যি দেখি/ নয়কো বেশি দূর,/ জাগিয়েছিল এ জাতিকে/ আসাদ মতিউর।.. ../ স্বাধীকারের প্রশ্ন এলে/ রাজপথে ফের দাঁড়াই ঠেলে,/ বুলেট গুলির সামনে হৃদয়/ করে না দুর দুর,/ আকাশ সমান সাহস যোগায়/ আসাদ-মতিউর’।
ছড়াকার আবু সালেহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর ছড়া নিয়ে রাজপথে ছিলেন! দেখুন তাঁর স্বৈরাচার বিরোধী উচ্চারণ- ‌‘এগিয়ে যাওয়া/ পিছিয়ে যাওয়া/ দাঁড়িয়ে থাকা নিরবে,/ এমন হলে আন্দোলনের/ মিছিল বলুন কি রবে?/ .. ..এ অবস্থা নিরসনে/ নেতৃবৃন্দ ভাবলে,/ স্বৈরশাসক পারবে না তো/ মাংস নিতে খাবলে।/ খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই নন/ পিছিয়ে থাকার সেনা,/ সময় বুঝেই ডাক যে দেবেন/ মুষ্ঠি তুলে নে না।’
একেবারে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু উদাহরণ দেখেন। সড়ক দুর্ঘটনা যখন আমাদের একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে তখন যোগাযোগ মন্ত্রীর উদাসীনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা শুনে কোন ছড়াকারই চুপ থাকতে পারেন না। তাইতো বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ছড়াশিল্পী লুৎফুর রহমান রিটন ফেসবুকে শেয়ার করলেন তাঁর সদ্য বানানো ছড়া-‘দেশের মানুষ কাঁদছে যখন আবুল তখন হাসে/ মর্যাদাহীন লোকটা শুধু টাকাই ভালবাসে।/ সড়ক জুড়ে মড়ক তবু আবুল কি তা মানে?/ মন্ত্রীত্ব টিকিয়ে রাখার মন্ত্র সে ঠিক জানে!/ হাসিনাকে ডুবিয়ে দিতে আবুল একাই একশ/ হাপিস করতে পটু আবুল জনগণের ট্যাকশ../ দেশের মানুষ ভোগান্তিতে ফুঁসছে মানুষ রাত দিন/ দোহাই লাগে শেখ হাসিনা আবুলটাকে বাদ দিন।/ শেখ হাসিনার পাশে/ ফাইল বগলে স্যুটেড-ব্যুটেড ব্যর্থ আবুল হাসে!’
লিমন নামের এক কিশোরকে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে র‌্যাব। করেছে তাকে সন্ত্রাসী বানানোর অপচেষ্টা। অন্য সকল মাধ্যমের মতো ছড়াও বসে নেই। দেখুন বর্তমান সময়ের ব্লগ সাহিত্যে বিচরণকারী ছড়াকার মাহফুজ মেহেদী কি বলছেন- ‘চোর ডাকাতের যন্ত্রণাতে/ শান্তি যাতে না হারায়,/ সে কারণেই বাড়তি কিছু/ লোক রেখেছি পাহারায়।/ অস্ত্র দিছি অর্থ দিছি/ শক্তি দিছি যাহাতে,/ সত্য পথে থাকে এবং/ কিছুই না নেয় বাঁ হাতে।/ তারপরেও আজকে কেন/ লিমন হলো পা হারা?/ এই কথাটার জবাবটা যে/ দিতেই হবে সাহারা।’
এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ছড়া সাহিত্য। এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে, আন্দোলন-সংগ্রামে, বিক্ষোভে-বিদ্রোহে আবার শান্তি ও সাম্যতেও। একমাত্র ছড়াতেই তো এভাবে বলা সম্ভব- ‘ছড়া আছে বিজয়ের মালাতে/ গরীবের ভাত চাওয়া থালাতে../ বদলাতে জানে ছড়া দিনকে/ ছড়া শোধ করে দেনা, ঋণ-কে!/ ..ছড়া দেখ সবদিকে ছড়ানো/ বৃক্ষের পাতা ডালে জড়ানো../ ছড়া আছে মানিব্যাগে, পকেটে/ ঘুরে ছড়া বিমানে ও রকেটে!/ ছড়া আছে রাজপথে রাজনীতি চর্চায়/ ছড়া শুধু শান্তি ও আরামের ঘর চায়!../ ছড়া তাই বিজয়ের পতাকা/ পতাকায় জনতার মত আঁকা।’
**ছড়ার প্রকাভেদ এই লেখকের নিজস্ব ভাবনা।