সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০১১

পুলিশ ছিল মারমুখো


পুলিশ ছিল মারমুখো

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি-জামায়াতের টানা ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে পুলিশ ছিল মারমুখো। ব্যাপক ধরপাকড়, পুলিশি অ্যাকশন আর ভ্রাম্যমাণ আদালতের ত্বরিত সাজার মধ্যে আতঙ্ক ছিল সর্বত্র। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখো অবস্থানের কারণে রাস্তাতেই নামতে পারেনি হরতালকারীরা। বিভিন্ন স্থানে হরতালের পক্ষে বিক্ষিপ্ত মিছিল-সমাবেশ ও পিকেটিং হলেও পুলিশি অ্যাকশনে নাজেহাল হতে হয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের। রাজধানীতে পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী এবং মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়াও হরতাল চলাকালে সাবেক দুই এমপি আবুল হোসেন খান ও কাজী সেকান্দার আলী ডালিম, মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সভানেত্রী নুরে আরা সাফা, বিএনপির গবেষণা সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব, যুবদল কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আবদুস সালাম আজাদ, মাহবুবুল ইসলাম স্বপন ও কৃষকদল নেতা শাহজাহান মিয়া সম্রাটসহ সারাদেশে ৭ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়ার অভিযোগ করেছে বিএনপি।
হরতালে পিকেটিং করতে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জে বরেণ্য সাংস্কৃতিক কর্মী গাজী মাযহারুল আনোয়ার, আবু সালেহ, মনির খান, রিজিয়া পারভিন, বেবি নাজনীনসহ সারাদেশে আহত হয়েছেন কয়েক শ। রাজধানীর রাজপথ ছিল অনেকটাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দখলে। সেই সঙ্গে নগরীর অলি-গলিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। টানা হরতালে গতকাল রাজধানীতে সীমিত সংখ্যক যান চলাচল করলেও ছাড়েনি কোন দূরপাল্লার বাস। ঢাকার রাস্তায় বিআরটিসিসহ গণপরিবহনের দু’একটি বাস চললেও তাতে যাত্রী সংখ্যা ছিল কম। হরতালে ট্রেন, লঞ্চ ও বিমান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। তবে লঞ্চ এবং ট্রেনে যাত্রী ছিল কম। অফিস-আদালতে কার্যক্রম চললেও উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের স্থলবন্দরগুলোতে পণ্য খালাস হলেও ট্রাক না চলায় অধিকাংশ বন্দর থেকেই পণ্য বের করা যায়নি। গতকাল রাজধানীতে তেমন কোন সহিংস ঘটনা না ঘটলেও মিরপুরে দুটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
আলতাফ চৌধুরী ও মেজর (অব.) হাফিজ গ্রেপ্তার : সকাল ১০টার দিকে মহাখালীতে গ্রেপ্তার হন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও পানিসম্পদ মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। পিকেটিংয়ের সময় মহাখালীতে এ দুই নেতার পাশাপাশি আরও ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গুলশান থানার ওসি শাহ আলম জানান, যান চলাচলে বাধা দেয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। সকাল থেকে ওই এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীরা পিকেটিংয়ের চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দুপুর পর্যন্ত এ এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করে।
মিরপুরে ২ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ: গতকাল সকালেই মিরপুরে কে বা কারা দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ছাড়া হরতাল চলাকালে ওই এলাকায় ৪টি বোমা এবং একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয় ৬ জামায়াত কর্মীকে। জানা যায়, পল্লবীর ৬ নম্বর সেকশনের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক মোড়ে বেলা আড়াইটার দিকে রাস্তার খালি জায়গায় ৪টি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে রুবেল এবং শামীম নামে ২ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে সকাল ৮টার দিকে পল্লবী থানা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি মিরপুর সাড়ে ১১ তে অনিক প্লাজার সামনে এলে পুলিশ মিছিলে বাধা দেয়। শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ৬ জামায়াত কর্মীকে আটক করে। এরা হলেন- আমিরুল মুমেনিন, আল ফাত্তাহ হাবিবুল্লাহ, জাহাঙ্গীর আলম, হুসেইন আহমেদ, জামাল উদ্দিন এবং নূরুল আমিন। পল্লবী থানার ওসি শাহাবুদ্দিন খলিফা জানান, পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়ার আভিযোগে ৬ জামায়াত কর্মীকে গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনস্থ আয়ুর্বেদিক কলেজের পাশে পার্কিংরত মাই লাইনের ঢাকা মেট্টো ব ১১-২৮২৫ নম্বরের গাড়িতে ভোর ৫টার দিকে আগুন দেয় কে বা কারা। ফায়ার সার্ভিস মিরপুর ইউনিটের একটি গাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। গাড়ির মালিক ফরিদ উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে কাফরুল থানায় একটি মামলা করেছেন। একই সময়ে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা অয়ুর্বেদিক কলেজের পাশে একটি গাড়িতে আগুন দেয়। গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্টো ব ১৪-০৭৭৩। গাড়িটি কৃষি ব্যাংক মতিঝিল শাখার স্টাফ বহনকারী। এ বিষয়ে গাড়ির মালিক আব্দুল কাদের বাদী হয়ে কাফরুল থানায় একটি মামলা করেছেন। দারুস সালাম থানা পুলিশ জানান, ১ নম্বর সেকশনের চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কে বা কারা একটি ককটেল নিক্ষেপ করে। এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
সারাদেশে গ্রেপ্তার ৭ শতাধিক: মতিঝিলে সাবেক এমপি আবুল হোসেনসহ ৭ জন, হাইকোর্ট এলাকায় এডভোকেট শরিফউদ্দিন ও নয়ন বাঙালিসহ ১৭ জন, নয়াপল্টনে ১৬ জন, রামপুরায় জাসাস নেতা সোহেলসহ ১১ জন, গুলিস্তানে যুবদল নেতা বেলালসহ ৬ জন, সবুজবাগে ৮ জন, লালবাগে ১৪ জন, শাহ আলীতে ১৩ জন, খিলক্ষেতে স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা সুজনসহ ১৭ জন, পল্লবীতে আজাদ হোসেনসহ ১১ জন, শেরে বাংলায় ১৫ জন, গুলশানে ৬ জন, মহাখালীতে ১৯ জন, সেগুনবাগিচায় বিএনপি নেতা আমির হোসেনসহ ১৭ জন, কেরানীগঞ্জে যুবদল নেতা আরিফ খানসহ ২৫ জন, খুলনা মহানগরে সাবেক এমপি কাজী সেকান্দার আলী ডালিম ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ সাদিসহ ৩০ জন, চট্টগ্রাম মহানগরে মহিলা দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী জেলী চৌধুরীসহ ৩১ জন, হবিগঞ্জে ছাত্রদল নেতা হারিছ চৌধুরীসহ ৯ জন, নীলফামারীতে যুবদল নেতা আতাউর রহমান পাপ্পুসহ ১৩ জন, ময়মনসিংহে ১৬ জন, কিশোরগঞ্জে ৯ জন, বগুড়ায় ১৫ জন, বরিশালে ১৫ জন, পটুয়াখালীতে ১৩ জন, চট্টগ্রাম উত্তরে ১২ জন, কুমিল্লা দক্ষিণে ১১ জন, পিরোজপুরে ১৯ জন, মাদারীপুরে ১৭ জন, বরগুনায় ১৩ জন ও জয়পুরহাটে ৬ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া র‌্যাবের হামলায় হবিগঞ্জে কৃষক দলনেতা ইলিয়াস ও শহীদ মিয়াসহ ৪০ জন আহত হয়েছে।
লাঠিচার্জে আহত একঝাঁক সাংস্কৃতিক তারকা: হরতালের সমর্থনে মিছিল করার সময় পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়েছেন একঝাঁক সাংস্কৃতিক তারকা। রাজধানীর এফডিসি এলাকায় পুলিশের লাঠিচার্জে বিএনপির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক কাজী মাযহারুল আনোয়ার, জাসাস সভাপতি এমএ মালেক, সাধারণ সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী মনির খান, বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ, কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন, রিজিয়া পারভিন, চিত্রনায়ক অমিত হাসানসহ প্রায় ৪০ জন সাংস্কৃতিক কর্মী আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর আহত আবু সালেহকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ সময় লাঠিচার্জের দৃশ্যধারণ করতে গিয়ে লাঠিচার্জের শিকার হয়েছেন বাংলাভিশনের একজন ক্যামেরাম্যান।
অবরুদ্ধ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়: ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম প্রহর থেকে অবরুদ্ধ ছিল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। র‌্যাব-পুলিশের মারমুখো অবস্থানে কোণঠাসা ছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা সবাই দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নেন। আগে থেকেই কার্যালয়ে ছিলেন দপ্তর সম্পাদকসহ আরও কয়েকজন নেতা। তবে পরবর্তীতে বাইরে থেকে কোন নেতাকর্মীকে কার্যালয়ে ঢুকতে বা বেরোতে দেয়া হয়নি। পুলিশ আশপাশের এলাকা থেকে বিএনপি কর্মী সন্দেহে দিনভর অন্তত ৩৫ জনকে আটক করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব, মহিলা দলের সভাপতি নুরী আরা সাফা, যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম আজাদ ও কৃষক দলের শাহজাহান মিয়া সম্রাট। এর আগে সকাল ৬টার পর মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দিনের প্রথম মিছিল বের করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের সঙ্গে পুলিশের বাগবিতণ্ডা ও ধস্তাধস্তি হয়। বাগবিতণ্ডা থামাতে গিয়ে মির্জা ফখরুল মাটিতে পড়ে যান এবং ডান হাতে ব্যথা পান। পুলিশ এ সময় সেখান থেকে ৮ নেতাকর্মীকে আটক করে। এর কিছু সময় পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মিছিলে বাধা ও গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকলে লাগাতার হরতালের হুমকি দিয়ে বলেন, পুলিশ যেভাবে আমাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তা চলতে থাকলে প্রয়োজনে আমরা ৭২ ঘণ্টা ও ৭ দিনের হরতাল দিতে বাধ্য হব। তিনি বলেন, কোন ধরনের পিকেটিং ছাড়াই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে হরতাল পালিত হচ্ছে। সকাল ৯টার দিকে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। পৌনে ১১টার দিকে মহিলা দলের সভাপতি নুরী আরা সাফা দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে আটক করে পুলিশ। তাকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলার দৃশ্যের ছবি তোলার সময় সাংবাদিকদের বাধা দেয় সাদা পোশাকধারী পুলিশ। এ সময় বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। এ নিয়ে প্রতিবাদ করেন সাংবাদিকরা। পুরো দিনে বিএনপি কার্যালয়ের আশপাশে ৬টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। সকাল সোয়া ৮টায় ফকিরাপুল মোড়ের কাছে ৩টি, সোয়া ১১টার দিকে মহানগর কার্যালয়ের ছাদে দু’টি ও দুপুর সোয়া ১টায় পার্টি অফিসের সামনে ফের আরেকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এদিকে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কাকরাইল মোড় থেকে যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের করার চেষ্টা করে যুবদল।
পুরান ঢাকার চিত্র: ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে রাজধানীর পুরান ঢাকার আদালতপাড়া ও সদরঘাট এলাকায় হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে কয়েকটি মিছিল ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে দুপুরে জজকোর্টের পূর্ব পাশের মূল গেটে দু’টি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। রাস্তায় যানবাহন চলাচল করলেও সংখ্যায় ছিল অনেক কম। সকালে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। আদালতের ভেতর থেকে তারা মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হতে চাইলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এ ছাড়া হরতালের পক্ষে কোন পিকেটারকেও রাস্তায় দেখা যায়নি। পুরো এলাকার মোড়ে মোড়ে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন ছিল। সকাল ১১টায় সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে জাতীয় ঘাট শ্রমিক লীগ হরতালের বিপক্ষে একটি মিছিল বের করে। তাদের এক ঘণ্টা পরে হরতালের পক্ষে আরেকটি মিছিল বের করে জাতীয়তাবাদী ঘাট শ্রমিক দল। তবে পুলিশি বাধার মুখে টার্মিনালের গেটেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। দুপুর ১২টায় হরতালের বিপক্ষে একটি মিছিল বের করে সরকারি কবি নজরুল কলেজ শাখা ছাত্রলীগ। সাড়ে ১২টায় আদালতের ভেতরে হরতালের সমর্থনে পুনরায় মিছিল বের করেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আইনজীবিরা। দুপুর ১টায় জজকোর্টের মেইন গেটের পূর্ব পাশে ন্যাশনাল হাসপাতালের গেটে হঠাৎ করে দু’টি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটে। তবে এতে কেউ আহত হয়নি। কোতোয়ালি জোনের (এসি) কামরুজ্জামান বলেন, নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে পিকেটাররা দুটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এদিকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে যথারীতি লঞ্চ চলাচল করেছে। তবে রাস্তায় যানবাহন কম থাকায় নৌ যাত্রীর সংখ্যাও অনেক কম ছিল। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ৩ নং গেটে টিকিট বিক্রেতা আবুল খায়ের জানান, অন্যান্য দিনের তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। চার ভাগের এশ ভাগ যাত্রীও নেই। ঘাটের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মাহফুজ মিয়া বলেন, কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে যাত্রী না থাকায় অনেক রুটে কোন লঞ্চ-স্টিমার ছাড়েনি।
হাইকোর্ট এলাকায় মিছিল সমাবেশ: হরতালের প্রথম দিন হাইকোর্ট এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা। হরতাল হওয়ায় আদালতের বিচারিক কার্যক্রমও চলেনি। হরতালের সমর্থনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ও ইসলামিক ল’ইয়ার্স কাউন্সিল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে সুপ্রিম কোর্টের বাইরে যেতে চাইলে প্রধান গেটের সামনে পুলিশ বাধা দেয়। এতে পুলিশের সঙ্গে আইনজীবীদের বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের এডিসি (রমনা) নুরুল ইসলাম বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার কায়সার কামালসহ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীকে গুলি করে হত্যা ও গায়ের চামড়া খুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। পরে আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার সভাপতিত্বে আইনজীবীরা প্রধান গেটের পাশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন প্রমুখ। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, সরকারের অন্যায় ও দেশবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা হরতাল পালন করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সরকার আমাদের সেই সাংবিধানিক অধিকার হরণ করছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করেছে। হরতালে বাধা দিয়ে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হয়রানি ও নির্যাতন করছে। মিছিল সমাবেশ করার সময় হাইকোর্ট এলাকা থেকে তিন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরা হলেন শরিফ ইউ আহমেদ, তাজুল ইসলাম মামীম ও নয়ন বাঙালি।
ঢাবি এলাকা: হরতাল চলকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারের সামনে দুপুরে ২টি ককটেল বোমা বিস্ফোরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশ এলাকায় বলতে গেলে শান্তিপূর্ণভাবেই হরতাল পালিত হয়েছে। ক্যাম্পাসসহ নীলক্ষেত, ঢাকা কলেজ, কাঁটাবন ও শাহবাগ এলাকায় হরতালের পক্ষে কোন মিছিল হয়নি। ছাত্রদলের কাউকেই ওইসব এলাকায় দেখা যায়নি। অথচ কেন্দ্রীয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার স্পট ছিল যথাক্রমে শাহবাগ এবং ক্যাম্পাস। তবে হরতালের বিপক্ষে দু’টি মিছিল হয়েছে। একটি বের করে কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ যৌথভাবে। অন্যটি বের করে ইডেন শাখা ছাত্রলীগ। এছাড়া হরতালের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পরীক্ষা হয়নি। নিজস্ব পরিবহন চলেনি। তবে অফিস ও লাইব্রেরি খোলা থাকলেও তাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। হরতালের বিপক্ষে দুপুরের দিকে প্রথম মিছিলটি বের হয় নীলক্ষেত এলাকায়। ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ আহ্বায়ক নিঝুমের নেতৃত্বে ওই মিছিল আশপাশ এলাকা প্রদক্ষিণ করে।
শতাধিক জামায়াত-শিবির কর্মী গ্রেপ্তার
৩৬ ঘণ্টা লাগাতার হরতাল পালনের প্রথম দিন গতকাল রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষিপ্ত মিছিল সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। এতে পুলিশ শতাধিক জামায়াত-শিবির কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের হামলায় প্রায় অর্ধশত শিবির কর্মী আহত হয়েছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত ১৮ শিবির কর্মীকে তাৎক্ষণিক সাজা দিয়েছে। গতকাল বিকালে বড় মগবাজার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, স্বৈরাচার আইয়ুব খানকে অনুসরণ করে শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন করছে। আতংক সৃষ্টির জন্য বিরোধী দলীয় কর্মীদের গ্রেপ্তার করে সঙ্গে সঙ্গে সাজা দিচ্ছে। এতে অনেক নিরীহ লোক বা পথচারীও হয়রানির শিকার হচ্ছে। যা আইনের শাসনের পরিপন্থি। তিনি বলেন, কোন গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের আদালত ও সাজা প্রদান গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গতকাল সকালে রাজধানীর ধোলাইরপাড় এলাকায় জামায়াতের একটি বিক্ষোভ মিছিলে যুবলীগের হামলায় ৯ জন আহত হয় দাবি করে আজহার বলেন, পুলিশের ছত্রছায়ায় তারা হামলা চালিয়ে আহত করার পরও জামায়াতের ২ কর্মীকে আটক করা হয়। তিনি বলেন, যতই নির্যাতন-নিপীড়ন চালাক গণবিস্ফোরণে এ সরকারের পতন হবে। দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুল ইসলাম, প্রচার সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনীম আলম, ঢাকা মহানগর আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সহকারী সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুল, শিবিরের সাবেক সভাপতি ড. রেজাউল করিম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ।
এদিকে হরতাল চলাকালে গতকাল রাজধানীর কমপক্ষে ১২টি স্পটে বিক্ষিপ্ত মিছিল সমাবেশ করেছে জামায়াত। তবে পুলিশ ও প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে এসব মিছিল সমাবেশের স্থায়িত্ব ছিল কয়েক মিনিট। সকালে শ্যামপুর থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন থানা আমীর আ জ ম রুহুল কুদ্দুস, কদমতলী থানা কর্মপরিষদ সদস্য মনির হোসাইন। মিছিলটি যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে শুরু হয়ে ধোলাইরপাড় যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ নামধারী একদল যুবক মিছিলে হামলা চালায়। এতে থানা আমীর আ জ ম রুহুল কুদ্দুসসহ ৮ জন নেতাকর্মী আহত হন। ছাত্রলীগের কর্মীরা দু’জামায়াত নেতা-কর্মীকে ধরে নিয়ে প্রচণ্ড মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রায় একই সময় পল্টন থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন থানা আমীর অধ্যাপক মোকাররম হোসাইন, শাহবাগ থানা আমীর এডভোকেট হেলাল উদ্দিন, পল্টন থানা সেক্রেটারি সাখাওয়াত হোসাইন। মিছিলটি ফকিরাপুল পানির ট্যাংকি থেকে শুরু হয়ে দৈনিক বাংলা হয়ে ফকিরাপুল মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় পুলিশ বা প্রতিপক্ষ কোন কর্মী ধারে কাছে না থাকায় কোন অঘটন ঘটেনি। বংশাল থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে গুলিস্তানে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগরী কর্মপরিষদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম ভূইয়া ও বংশাল থানা আমীর এস এম রুহুল আমীন। মিছিলটি ফুলবাড়িয়া থেকে শুরু করে প্‌বার্শবর্তী সড়কে গিয়ে শেষ হয়। হাজারীবাগ থানা আমীর শেখ শরীফ উদ্দিন আহমদ, সেক্রেটারি আবদুল বারী আকন্দ, শিবিরের থানা সভাপতি নজরুল ইসালমের নেতৃত্বে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি ট্যানারি মোড় তল্লাবাগ থেকে টালি অফিস রোড, বাংলা সড়ক, রায়েরবাজার হাইস্কুল, ১৫ নং স্টাফ কোয়ার্টার হয়ে ধানমন্ডি ১৫নং বাসস্টান্ডে গিয়ে শেষ হয়। গুলশান থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে মহাখালীতে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন গুলশান থানা আমীর এ আর এম মনির, থানা কর্মপরিষদ সদস্য সাইফুল ইসলাম ও জামায়াত নেতা নেছারউদ্দিন, মহানগরী উত্তর শিবির নেতা মিজানুর রহমান খান, গুশলান থানা শিবির সভাপতি মিজানুর রহমান, তিতুমীর কলেজ সভাপতি মো. রাসেল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি হাচান মো. ইউসুফ। মিছিলটি মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু হয়ে রেলগেট দিয়ে মহাখালী দক্ষিণ গেটে গিয়ে শেষ হয়। সূত্রাপুর থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন থানা কর্মপরিষদ সদস্য রেজাউর রহমান খান, মো. কামরুল আহসান হাসান, ছাত্রশিবির মহানগরী দক্ষিণ সেক্রেটারি শাহ মু. মাহফুজুল হক, ছাত্রনেতা সাদেক বিল্লাহ, মিজানুর রহমান, মু. আবু ইউসুফ, শিহাব উদ্দিন, ইমতিয়াজ হোসেন, জামায়াত নেতা আব্দুল্লাহ মাহমুদ বাবুল, মাওলানা রফিকুল ইসলাম, নূরুল ইসলাম, আব্দুর রশিদ প্রমুখ। রমনা থানা আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, থানা সেক্রেটারি ড. মু. রেজাউল করিম, রমনা থানা শিবির সভাপতি রওশন আহমেদের নেতৃত্বে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বেইলি রোড থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শান্তিনগরে গিয়ে শেষ হয়। মীরপুর ও কাফরুল থানার যৌথ উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে ১০ নম্বর গোলচত্বরে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন কাফরুল থানা আমীর লস্কর মোহাম্মদ তাসলীম, থানা সেক্রেটারি অধ্যাপক আনোয়ারুল করিম, মিরপুর পূর্ব থানা সেক্রেটারি মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, জামায়াত নেতা আলাউদ্দিন মোল্লা ও আবদুল মতিন খান, শিবির নেতা সোহেল। মিছিলটি মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে শুরু হয়ে কাজীপাড়া গিয়ে শেষ হয়। যাত্রাবাড়ী থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন যাত্রাবাড়ী থানা আমীর আবদুস সবুর ফকির, থানা সেক্রেটারি মাহমুদ হোসাইন, জামায়াত নেতা নাজির আহমেদ ভূঁইয়া ও সিরাজুল ইসলাম, শিবির মহানগরী দক্ষিনের সভাপতি হাফেজ জহির উদ্দিন ও সেক্রেটারি শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, যাত্রাবাড়ী থানা সভাপতি মাঈন উদ্দিন প্রমুখ। মিছিলটি শহীদ ফারুক সড়ক থেকে শুরু হয়ে দয়াগঞ্জ দিয়ে ধোলাইরপাড় গিয়ে শেষ হয়। আদাবর ও মোহাম্মদপুর থানার যৌথ উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে শ্যামলীতে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদপুর থানা আমীর মাওলানা রফিক আহমদ, আদাবর থানা আমীর দেলোয়ার হোসাইন, সেক্রেটারী আ ন ম হাসান নোমান, মহানগরী পশ্চিম সেক্রেটারি সাজ্জাদ হোসাইন ও জামায়াত নেতা আলী আকরাম মোহাম্মদ ওজায়ের প্রমুখ। মিছিলটি তাজমহল রোড থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। খিলগাঁও থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মহানগরী কর্মপরিষদ সদস্য কবির আহমদ, খিলগাঁও থানা সেক্রেটারি সগির বিন সাঈদ, শিবির নেতা আবদুল কাদের ও আশরাফুল ইসলাম। মিছিলটি খিলগাঁও তিলপাপাড়া থেকে শুরু হয়ে সিটি করপোরেশন অফিসের কাছে গিয়ে শেষ হয়। পল্লবী থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করতে গেলে পুলিশ মিছিলকারীদের ব্যানার ছিনিয়ে নেয় এবং ৬ জন জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- জাহাঙ্গীর আলম, নুরুল আমীন, জামালউদ্দিন, হাবিবুল্লাহ, হাফেজ হোসাইন মাহমুদ ও আমিরুল মুমিনিন।
স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি-জামায়াতের টানা ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে পুলিশ ছিল মারমুখো। ব্যাপক ধরপাকড়, পুলিশি অ্যাকশন আর ভ্রাম্যমাণ আদালতের ত্বরিত সাজার মধ্যে আতঙ্ক ছিল সর্বত্র। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখো অবস্থানের কারণে রাস্তাতেই নামতে পারেনি হরতালকারীরা। বিভিন্ন স্থানে হরতালের পক্ষে বিক্ষিপ্ত মিছিল-সমাবেশ ও পিকেটিং হলেও পুলিশি অ্যাকশনে নাজেহাল হতে হয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের। রাজধানীতে পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী এবং মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়াও হরতাল চলাকালে সাবেক দুই এমপি আবুল হোসেন খান ও কাজী সেকান্দার আলী ডালিম, মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সভানেত্রী নুরে আরা সাফা, বিএনপির গবেষণা সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব, যুবদল কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আবদুস সালাম আজাদ, মাহবুবুল ইসলাম স্বপন ও কৃষকদল নেতা শাহজাহান মিয়া সম্রাটসহ সারাদেশে ৭ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়ার অভিযোগ করেছে বিএনপি।
হরতালে পিকেটিং করতে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জে বরেণ্য সাংস্কৃতিক কর্মী গাজী মাযহারুল আনোয়ার, আবু সালেহ, মনির খান, রিজিয়া পারভিন, বেবি নাজনীনসহ সারাদেশে আহত হয়েছেন কয়েক শ। রাজধানীর রাজপথ ছিল অনেকটাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দখলে। সেই সঙ্গে নগরীর অলি-গলিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। টানা হরতালে গতকাল রাজধানীতে সীমিত সংখ্যক যান চলাচল করলেও ছাড়েনি কোন দূরপাল্লার বাস। ঢাকার রাস্তায় বিআরটিসিসহ গণপরিবহনের দু’একটি বাস চললেও তাতে যাত্রী সংখ্যা ছিল কম। হরতালে ট্রেন, লঞ্চ ও বিমান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। তবে লঞ্চ এবং ট্রেনে যাত্রী ছিল কম। অফিস-আদালতে কার্যক্রম চললেও উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের স্থলবন্দরগুলোতে পণ্য খালাস হলেও ট্রাক না চলায় অধিকাংশ বন্দর থেকেই পণ্য বের করা যায়নি। গতকাল রাজধানীতে তেমন কোন সহিংস ঘটনা না ঘটলেও মিরপুরে দুটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
আলতাফ চৌধুরী ও মেজর (অব.) হাফিজ গ্রেপ্তার : সকাল ১০টার দিকে মহাখালীতে গ্রেপ্তার হন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও পানিসম্পদ মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। পিকেটিংয়ের সময় মহাখালীতে এ দুই নেতার পাশাপাশি আরও ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গুলশান থানার ওসি শাহ আলম জানান, যান চলাচলে বাধা দেয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। সকাল থেকে ওই এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীরা পিকেটিংয়ের চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দুপুর পর্যন্ত এ এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করে।
মিরপুরে ২ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ: গতকাল সকালেই মিরপুরে কে বা কারা দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ছাড়া হরতাল চলাকালে ওই এলাকায় ৪টি বোমা এবং একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয় ৬ জামায়াত কর্মীকে। জানা যায়, পল্লবীর ৬ নম্বর সেকশনের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক মোড়ে বেলা আড়াইটার দিকে রাস্তার খালি জায়গায় ৪টি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে রুবেল এবং শামীম নামে ২ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে সকাল ৮টার দিকে পল্লবী থানা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি মিরপুর সাড়ে ১১ তে অনিক প্লাজার সামনে এলে পুলিশ মিছিলে বাধা দেয়। শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ৬ জামায়াত কর্মীকে আটক করে। এরা হলেন- আমিরুল মুমেনিন, আল ফাত্তাহ হাবিবুল্লাহ, জাহাঙ্গীর আলম, হুসেইন আহমেদ, জামাল উদ্দিন এবং নূরুল আমিন। পল্লবী থানার ওসি শাহাবুদ্দিন খলিফা জানান, পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়ার আভিযোগে ৬ জামায়াত কর্মীকে গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনস্থ আয়ুর্বেদিক কলেজের পাশে পার্কিংরত মাই লাইনের ঢাকা মেট্টো ব ১১-২৮২৫ নম্বরের গাড়িতে ভোর ৫টার দিকে আগুন দেয় কে বা কারা। ফায়ার সার্ভিস মিরপুর ইউনিটের একটি গাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। গাড়ির মালিক ফরিদ উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে কাফরুল থানায় একটি মামলা করেছেন। একই সময়ে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা অয়ুর্বেদিক কলেজের পাশে একটি গাড়িতে আগুন দেয়। গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্টো ব ১৪-০৭৭৩। গাড়িটি কৃষি ব্যাংক মতিঝিল শাখার স্টাফ বহনকারী। এ বিষয়ে গাড়ির মালিক আব্দুল কাদের বাদী হয়ে কাফরুল থানায় একটি মামলা করেছেন। দারুস সালাম থানা পুলিশ জানান, ১ নম্বর সেকশনের চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কে বা কারা একটি ককটেল নিক্ষেপ করে। এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
সারাদেশে গ্রেপ্তার ৭ শতাধিক: মতিঝিলে সাবেক এমপি আবুল হোসেনসহ ৭ জন, হাইকোর্ট এলাকায় এডভোকেট শরিফউদ্দিন ও নয়ন বাঙালিসহ ১৭ জন, নয়াপল্টনে ১৬ জন, রামপুরায় জাসাস নেতা সোহেলসহ ১১ জন, গুলিস্তানে যুবদল নেতা বেলালসহ ৬ জন, সবুজবাগে ৮ জন, লালবাগে ১৪ জন, শাহ আলীতে ১৩ জন, খিলক্ষেতে স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা সুজনসহ ১৭ জন, পল্লবীতে আজাদ হোসেনসহ ১১ জন, শেরে বাংলায় ১৫ জন, গুলশানে ৬ জন, মহাখালীতে ১৯ জন, সেগুনবাগিচায় বিএনপি নেতা আমির হোসেনসহ ১৭ জন, কেরানীগঞ্জে যুবদল নেতা আরিফ খানসহ ২৫ জন, খুলনা মহানগরে সাবেক এমপি কাজী সেকান্দার আলী ডালিম ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ সাদিসহ ৩০ জন, চট্টগ্রাম মহানগরে মহিলা দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী জেলী চৌধুরীসহ ৩১ জন, হবিগঞ্জে ছাত্রদল নেতা হারিছ চৌধুরীসহ ৯ জন, নীলফামারীতে যুবদল নেতা আতাউর রহমান পাপ্পুসহ ১৩ জন, ময়মনসিংহে ১৬ জন, কিশোরগঞ্জে ৯ জন, বগুড়ায় ১৫ জন, বরিশালে ১৫ জন, পটুয়াখালীতে ১৩ জন, চট্টগ্রাম উত্তরে ১২ জন, কুমিল্লা দক্ষিণে ১১ জন, পিরোজপুরে ১৯ জন, মাদারীপুরে ১৭ জন, বরগুনায় ১৩ জন ও জয়পুরহাটে ৬ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া র‌্যাবের হামলায় হবিগঞ্জে কৃষক দলনেতা ইলিয়াস ও শহীদ মিয়াসহ ৪০ জন আহত হয়েছে।
লাঠিচার্জে আহত একঝাঁক সাংস্কৃতিক তারকা: হরতালের সমর্থনে মিছিল করার সময় পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়েছেন একঝাঁক সাংস্কৃতিক তারকা। রাজধানীর এফডিসি এলাকায় পুলিশের লাঠিচার্জে বিএনপির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক কাজী মাযহারুল আনোয়ার, জাসাস সভাপতি এমএ মালেক, সাধারণ সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী মনির খান, বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ, কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন, রিজিয়া পারভিন, চিত্রনায়ক অমিত হাসানসহ প্রায় ৪০ জন সাংস্কৃতিক কর্মী আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর আহত আবু সালেহকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ সময় লাঠিচার্জের দৃশ্যধারণ করতে গিয়ে লাঠিচার্জের শিকার হয়েছেন বাংলাভিশনের একজন ক্যামেরাম্যান।
অবরুদ্ধ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়: ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম প্রহর থেকে অবরুদ্ধ ছিল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। র‌্যাব-পুলিশের মারমুখো অবস্থানে কোণঠাসা ছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা সবাই দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নেন। আগে থেকেই কার্যালয়ে ছিলেন দপ্তর সম্পাদকসহ আরও কয়েকজন নেতা। তবে পরবর্তীতে বাইরে থেকে কোন নেতাকর্মীকে কার্যালয়ে ঢুকতে বা বেরোতে দেয়া হয়নি। পুলিশ আশপাশের এলাকা থেকে বিএনপি কর্মী সন্দেহে দিনভর অন্তত ৩৫ জনকে আটক করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব, মহিলা দলের সভাপতি নুরী আরা সাফা, যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম আজাদ ও কৃষক দলের শাহজাহান মিয়া সম্রাট। এর আগে সকাল ৬টার পর মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দিনের প্রথম মিছিল বের করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের সঙ্গে পুলিশের বাগবিতণ্ডা ও ধস্তাধস্তি হয়। বাগবিতণ্ডা থামাতে গিয়ে মির্জা ফখরুল মাটিতে পড়ে যান এবং ডান হাতে ব্যথা পান। পুলিশ এ সময় সেখান থেকে ৮ নেতাকর্মীকে আটক করে। এর কিছু সময় পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মিছিলে বাধা ও গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকলে লাগাতার হরতালের হুমকি দিয়ে বলেন, পুলিশ যেভাবে আমাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তা চলতে থাকলে প্রয়োজনে আমরা ৭২ ঘণ্টা ও ৭ দিনের হরতাল দিতে বাধ্য হব। তিনি বলেন, কোন ধরনের পিকেটিং ছাড়াই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে হরতাল পালিত হচ্ছে। সকাল ৯টার দিকে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। পৌনে ১১টার দিকে মহিলা দলের সভাপতি নুরী আরা সাফা দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে আটক করে পুলিশ। তাকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলার দৃশ্যের ছবি তোলার সময় সাংবাদিকদের বাধা দেয় সাদা পোশাকধারী পুলিশ। এ সময় বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। এ নিয়ে প্রতিবাদ করেন সাংবাদিকরা। পুরো দিনে বিএনপি কার্যালয়ের আশপাশে ৬টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। সকাল সোয়া ৮টায় ফকিরাপুল মোড়ের কাছে ৩টি, সোয়া ১১টার দিকে মহানগর কার্যালয়ের ছাদে দু’টি ও দুপুর সোয়া ১টায় পার্টি অফিসের সামনে ফের আরেকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এদিকে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কাকরাইল মোড় থেকে যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের করার চেষ্টা করে যুবদল।
পুরান ঢাকার চিত্র: ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে রাজধানীর পুরান ঢাকার আদালতপাড়া ও সদরঘাট এলাকায় হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে কয়েকটি মিছিল ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে দুপুরে জজকোর্টের পূর্ব পাশের মূল গেটে দু’টি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। রাস্তায় যানবাহন চলাচল করলেও সংখ্যায় ছিল অনেক কম। সকালে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। আদালতের ভেতর থেকে তারা মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হতে চাইলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এ ছাড়া হরতালের পক্ষে কোন পিকেটারকেও রাস্তায় দেখা যায়নি। পুরো এলাকার মোড়ে মোড়ে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন ছিল। সকাল ১১টায় সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে জাতীয় ঘাট শ্রমিক লীগ হরতালের বিপক্ষে একটি মিছিল বের করে। তাদের এক ঘণ্টা পরে হরতালের পক্ষে আরেকটি মিছিল বের করে জাতীয়তাবাদী ঘাট শ্রমিক দল। তবে পুলিশি বাধার মুখে টার্মিনালের গেটেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। দুপুর ১২টায় হরতালের বিপক্ষে একটি মিছিল বের করে সরকারি কবি নজরুল কলেজ শাখা ছাত্রলীগ। সাড়ে ১২টায় আদালতের ভেতরে হরতালের সমর্থনে পুনরায় মিছিল বের করেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আইনজীবিরা। দুপুর ১টায় জজকোর্টের মেইন গেটের পূর্ব পাশে ন্যাশনাল হাসপাতালের গেটে হঠাৎ করে দু’টি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটে। তবে এতে কেউ আহত হয়নি। কোতোয়ালি জোনের (এসি) কামরুজ্জামান বলেন, নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে পিকেটাররা দুটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এদিকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে যথারীতি লঞ্চ চলাচল করেছে। তবে রাস্তায় যানবাহন কম থাকায় নৌ যাত্রীর সংখ্যাও অনেক কম ছিল। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ৩ নং গেটে টিকিট বিক্রেতা আবুল খায়ের জানান, অন্যান্য দিনের তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। চার ভাগের এশ ভাগ যাত্রীও নেই। ঘাটের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মাহফুজ মিয়া বলেন, কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে যাত্রী না থাকায় অনেক রুটে কোন লঞ্চ-স্টিমার ছাড়েনি।
হাইকোর্ট এলাকায় মিছিল সমাবেশ: হরতালের প্রথম দিন হাইকোর্ট এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা। হরতাল হওয়ায় আদালতের বিচারিক কার্যক্রমও চলেনি। হরতালের সমর্থনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ও ইসলামিক ল’ইয়ার্স কাউন্সিল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে সুপ্রিম কোর্টের বাইরে যেতে চাইলে প্রধান গেটের সামনে পুলিশ বাধা দেয়। এতে পুলিশের সঙ্গে আইনজীবীদের বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের এডিসি (রমনা) নুরুল ইসলাম বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার কায়সার কামালসহ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীকে গুলি করে হত্যা ও গায়ের চামড়া খুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। পরে আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার সভাপতিত্বে আইনজীবীরা প্রধান গেটের পাশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন প্রমুখ। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, সরকারের অন্যায় ও দেশবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা হরতাল পালন করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সরকার আমাদের সেই সাংবিধানিক অধিকার হরণ করছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করেছে। হরতালে বাধা দিয়ে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হয়রানি ও নির্যাতন করছে। মিছিল সমাবেশ করার সময় হাইকোর্ট এলাকা থেকে তিন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরা হলেন শরিফ ইউ আহমেদ, তাজুল ইসলাম মামীম ও নয়ন বাঙালি।
ঢাবি এলাকা: হরতাল চলকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারের সামনে দুপুরে ২টি ককটেল বোমা বিস্ফোরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশ এলাকায় বলতে গেলে শান্তিপূর্ণভাবেই হরতাল পালিত হয়েছে। ক্যাম্পাসসহ নীলক্ষেত, ঢাকা কলেজ, কাঁটাবন ও শাহবাগ এলাকায় হরতালের পক্ষে কোন মিছিল হয়নি। ছাত্রদলের কাউকেই ওইসব এলাকায় দেখা যায়নি। অথচ কেন্দ্রীয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার স্পট ছিল যথাক্রমে শাহবাগ এবং ক্যাম্পাস। তবে হরতালের বিপক্ষে দু’টি মিছিল হয়েছে। একটি বের করে কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ যৌথভাবে। অন্যটি বের করে ইডেন শাখা ছাত্রলীগ। এছাড়া হরতালের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পরীক্ষা হয়নি। নিজস্ব পরিবহন চলেনি। তবে অফিস ও লাইব্রেরি খোলা থাকলেও তাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। হরতালের বিপক্ষে দুপুরের দিকে প্রথম মিছিলটি বের হয় নীলক্ষেত এলাকায়। ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ আহ্বায়ক নিঝুমের নেতৃত্বে ওই মিছিল আশপাশ এলাকা প্রদক্ষিণ করে।
শতাধিক জামায়াত-শিবির কর্মী গ্রেপ্তার
৩৬ ঘণ্টা লাগাতার হরতাল পালনের প্রথম দিন গতকাল রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষিপ্ত মিছিল সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। এতে পুলিশ শতাধিক জামায়াত-শিবির কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের হামলায় প্রায় অর্ধশত শিবির কর্মী আহত হয়েছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত ১৮ শিবির কর্মীকে তাৎক্ষণিক সাজা দিয়েছে। গতকাল বিকালে বড় মগবাজার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, স্বৈরাচার আইয়ুব খানকে অনুসরণ করে শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন করছে। আতংক সৃষ্টির জন্য বিরোধী দলীয় কর্মীদের গ্রেপ্তার করে সঙ্গে সঙ্গে সাজা দিচ্ছে। এতে অনেক নিরীহ লোক বা পথচারীও হয়রানির শিকার হচ্ছে। যা আইনের শাসনের পরিপন্থি। তিনি বলেন, কোন গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের আদালত ও সাজা প্রদান গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গতকাল সকালে রাজধানীর ধোলাইরপাড় এলাকায় জামায়াতের একটি বিক্ষোভ মিছিলে যুবলীগের হামলায় ৯ জন আহত হয় দাবি করে আজহার বলেন, পুলিশের ছত্রছায়ায় তারা হামলা চালিয়ে আহত করার পরও জামায়াতের ২ কর্মীকে আটক করা হয়। তিনি বলেন, যতই নির্যাতন-নিপীড়ন চালাক গণবিস্ফোরণে এ সরকারের পতন হবে। দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুল ইসলাম, প্রচার সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনীম আলম, ঢাকা মহানগর আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সহকারী সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুল, শিবিরের সাবেক সভাপতি ড. রেজাউল করিম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ।
এদিকে হরতাল চলাকালে গতকাল রাজধানীর কমপক্ষে ১২টি স্পটে বিক্ষিপ্ত মিছিল সমাবেশ করেছে জামায়াত। তবে পুলিশ ও প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে এসব মিছিল সমাবেশের স্থায়িত্ব ছিল কয়েক মিনিট। সকালে শ্যামপুর থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন থানা আমীর আ জ ম রুহুল কুদ্দুস, কদমতলী থানা কর্মপরিষদ সদস্য মনির হোসাইন। মিছিলটি যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে শুরু হয়ে ধোলাইরপাড় যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ নামধারী একদল যুবক মিছিলে হামলা চালায়। এতে থানা আমীর আ জ ম রুহুল কুদ্দুসসহ ৮ জন নেতাকর্মী আহত হন। ছাত্রলীগের কর্মীরা দু’জামায়াত নেতা-কর্মীকে ধরে নিয়ে প্রচণ্ড মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রায় একই সময় পল্টন থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন থানা আমীর অধ্যাপক মোকাররম হোসাইন, শাহবাগ থানা আমীর এডভোকেট হেলাল উদ্দিন, পল্টন থানা সেক্রেটারি সাখাওয়াত হোসাইন। মিছিলটি ফকিরাপুল পানির ট্যাংকি থেকে শুরু হয়ে দৈনিক বাংলা হয়ে ফকিরাপুল মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় পুলিশ বা প্রতিপক্ষ কোন কর্মী ধারে কাছে না থাকায় কোন অঘটন ঘটেনি। বংশাল থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে গুলিস্তানে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগরী কর্মপরিষদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম ভূইয়া ও বংশাল থানা আমীর এস এম রুহুল আমীন। মিছিলটি ফুলবাড়িয়া থেকে শুরু করে প্‌বার্শবর্তী সড়কে গিয়ে শেষ হয়। হাজারীবাগ থানা আমীর শেখ শরীফ উদ্দিন আহমদ, সেক্রেটারি আবদুল বারী আকন্দ, শিবিরের থানা সভাপতি নজরুল ইসালমের নেতৃত্বে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি ট্যানারি মোড় তল্লাবাগ থেকে টালি অফিস রোড, বাংলা সড়ক, রায়েরবাজার হাইস্কুল, ১৫ নং স্টাফ কোয়ার্টার হয়ে ধানমন্ডি ১৫নং বাসস্টান্ডে গিয়ে শেষ হয়। গুলশান থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে মহাখালীতে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন গুলশান থানা আমীর এ আর এম মনির, থানা কর্মপরিষদ সদস্য সাইফুল ইসলাম ও জামায়াত নেতা নেছারউদ্দিন, মহানগরী উত্তর শিবির নেতা মিজানুর রহমান খান, গুশলান থানা শিবির সভাপতি মিজানুর রহমান, তিতুমীর কলেজ সভাপতি মো. রাসেল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি হাচান মো. ইউসুফ। মিছিলটি মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু হয়ে রেলগেট দিয়ে মহাখালী দক্ষিণ গেটে গিয়ে শেষ হয়। সূত্রাপুর থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন থানা কর্মপরিষদ সদস্য রেজাউর রহমান খান, মো. কামরুল আহসান হাসান, ছাত্রশিবির মহানগরী দক্ষিণ সেক্রেটারি শাহ মু. মাহফুজুল হক, ছাত্রনেতা সাদেক বিল্লাহ, মিজানুর রহমান, মু. আবু ইউসুফ, শিহাব উদ্দিন, ইমতিয়াজ হোসেন, জামায়াত নেতা আব্দুল্লাহ মাহমুদ বাবুল, মাওলানা রফিকুল ইসলাম, নূরুল ইসলাম, আব্দুর রশিদ প্রমুখ। রমনা থানা আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, থানা সেক্রেটারি ড. মু. রেজাউল করিম, রমনা থানা শিবির সভাপতি রওশন আহমেদের নেতৃত্বে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বেইলি রোড থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শান্তিনগরে গিয়ে শেষ হয়। মীরপুর ও কাফরুল থানার যৌথ উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে ১০ নম্বর গোলচত্বরে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন কাফরুল থানা আমীর লস্কর মোহাম্মদ তাসলীম, থানা সেক্রেটারি অধ্যাপক আনোয়ারুল করিম, মিরপুর পূর্ব থানা সেক্রেটারি মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, জামায়াত নেতা আলাউদ্দিন মোল্লা ও আবদুল মতিন খান, শিবির নেতা সোহেল। মিছিলটি মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে শুরু হয়ে কাজীপাড়া গিয়ে শেষ হয়। যাত্রাবাড়ী থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন যাত্রাবাড়ী থানা আমীর আবদুস সবুর ফকির, থানা সেক্রেটারি মাহমুদ হোসাইন, জামায়াত নেতা নাজির আহমেদ ভূঁইয়া ও সিরাজুল ইসলাম, শিবির মহানগরী দক্ষিনের সভাপতি হাফেজ জহির উদ্দিন ও সেক্রেটারি শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, যাত্রাবাড়ী থানা সভাপতি মাঈন উদ্দিন প্রমুখ। মিছিলটি শহীদ ফারুক সড়ক থেকে শুরু হয়ে দয়াগঞ্জ দিয়ে ধোলাইরপাড় গিয়ে শেষ হয়। আদাবর ও মোহাম্মদপুর থানার যৌথ উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে শ্যামলীতে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদপুর থানা আমীর মাওলানা রফিক আহমদ, আদাবর থানা আমীর দেলোয়ার হোসাইন, সেক্রেটারী আ ন ম হাসান নোমান, মহানগরী পশ্চিম সেক্রেটারি সাজ্জাদ হোসাইন ও জামায়াত নেতা আলী আকরাম মোহাম্মদ ওজায়ের প্রমুখ। মিছিলটি তাজমহল রোড থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। খিলগাঁও থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মহানগরী কর্মপরিষদ সদস্য কবির আহমদ, খিলগাঁও থানা সেক্রেটারি সগির বিন সাঈদ, শিবির নেতা আবদুল কাদের ও আশরাফুল ইসলাম। মিছিলটি খিলগাঁও তিলপাপাড়া থেকে শুরু হয়ে সিটি করপোরেশন অফিসের কাছে গিয়ে শেষ হয়। পল্লবী থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করতে গেলে পুলিশ মিছিলকারীদের ব্যানার ছিনিয়ে নেয় এবং ৬ জন জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- জাহাঙ্গীর আলম, নুরুল আমীন, জামালউদ্দিন, হাবিবুল্লাহ, হাফেজ হোসাইন মাহমুদ ও আমিরুল মুমিনিন।

    কোন মন্তব্য নেই:

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন